top of page
Pink Paper

দেড়শ বছরের সঙ্গী বুড়ো ট্রামকে বিদায় জানাচ্ছে মহানগর

Writer's picture: Anirban DasAnirban Das

কলকাতা আজ বড্ড ব্যস্ত। বুড়ো ট্রামের বোঝা সে আর বইতে নারাজ। একদিন এই তিলোত্তমাকে দেখে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে” -আজ হয়তো তিনি কলকাতা দেখে ‘ছুটিতেছে কলিকাতা ঝড়ের গতিতে’ -এ জাতীয় কিছু লিখতেন। অবশেষে এই গতির কাছে হার মানলো কলকাতার ১৫০ বছরের সফর সঙ্গী ট্রাম। শহরতলি থেকে সদ্য কলকাতায় পা রাখা কোনো কিশোর আর হেঁদুয়ার মোড়ে দাঁড়িয়ে কলেজস্ট্রিটগামী ট্রামের জন্য অপেক্ষা করবে না; ট্রামের শেষ জানলা থেকে মুখ বাড়িয়ে আকাশ ঘেঁটে দেওয়া তারের জটলায় খুঁজবে না কবিতা লাইন, শহর আর সময়ের গতির কাছে কিছুটা সময় চেয়ে শ্লথ কোনো রঙ চটা ট্রামের কামরায় প্রেমিকার পাশে আরেকটু বসে থাকার অজুহাত খুঁজবে না… ট্রামের ঘন্টা, ঘর্ঘর, সেকেন্ড ক্লাস আর ‘চল রাস্তায় সাজি ট্রাম লাইন’-এর নস্টালজিয়াও অতীত হলো; কারণ শুধু যে ট্রাম নয়, থাকছে না ট্রামের লাইনও।


কিছুদিন আগের একটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি, বৃষ্টিহীন শ্রাবণের এক দুপুরে মৌলালি পেরিয়ে স্কুটিতে সস্ত্রীক যাচ্ছিলাম এক আত্মীয়ের বাড়ি। যানজট, ধিমে গতির ট্রাফিকের কারণে আজকাল উত্তর কলকাতার রাস্তা আর ভালোলাগে না। শিয়ালদহ ব্রিজের আগের সিগন্যালে সেদিন আমাদের দু’জনেরই ভবলীলা সাঙ্গ হতো! বাইক কেনার পর জীবনে প্রথম উল্টেছিলাম ট্রাম লাইনে, তারপর থেকে একটু সমঝেই চলি। কিন্তু সেদিন আগে-পিছে, ডাইনে-বাঁয়ে গাড়ি থাকায় সম্ভব ছিল না। সিগন্যাল খুলতে একটু এগিয়ে যেই না ব্রেক কষা, দু’জনেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে ধাক্কা খেলাম পিছন থেকে আসা বাসে। আর কয়েক ইঞ্চির ব্যবধানে আমাদের পা, শরীর বাসের চাকা থেকে সেদিন বেঁচে গিয়েছিল। কিন্তু তার দু’দিন আগে সেখানে এরকমই এক দুর্ঘটনায় এক বাইক আরোহী আমাদের মতো ভাগ্যবান ছিলেন না। তাই কলকাতার ট্রামের আবেগ-ইতিহাস-নস্টালজিয়ার সমান্তরালে এরকম অনেক মর্মান্তিক খবরই থম মেরে আছে। তবে আজ লিখতে বসলাম যখন, একটু ট্রামের ইতিহাস ফিরে দেখা যাক?      


শুরু হয়েই ছন্দপতন: বন্ধ হলো কলকাতার প্রথম ট্রাম

ট্রামের ইতিহাসটা বেশ ইন্টারেস্টিং। শুরুটা হয়েছিল ১৮৬৭ সালে, যখন ব্রিটিশ শাসনাধীন কলকাতায় ট্রাম চালু করার ভাবনা মাথায় আসে। সেসময়ে শহরের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির প্রয়োজন ছিল। যাতে একসঙ্গে অনেকটা পরিমাণ পণ্য এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিয়ে যেওয়া যায়। তাই ট্রাম নিয়ে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিল শিয়ালদহ স্টেশন থেকে মালপত্র শহরের বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে দেওয়া। এই লক্ষ্যেই ১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ট্রাম চলে কলকাতায়, আর সেটা ছিল ঘোড়ায় টানা ট্রাম। কিন্তু সে সময় ঠিকমত পরিকল্পনা আর দক্ষতা না থাকার ফলে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও লোকসানের সম্মুখীন হয়ে প্রথম ট্রাম সার্ভিস বেশি দিন টিকলো না। মাত্র নয় মাস পর, ১৮৭৩ সালের ২১ নভেম্বর, বন্ধ হয়ে গেল কলকাতার প্রথম ট্রাম। কিন্তু ততদিনে দেড় লক্ষাধিক টাকা খরচ করে পাতা হয়েছে লাইন, এসেছে গাড়ি। তাদের কী হবে? তখন ইংরেজ ব্যবসায়ী অ্যালফ্রেড পারিস ও রবিনসন সাউদার এগিয়ে এসে নতুনভাবে কলকাতায় ট্রাম চালানোর প্রস্তাব দিলেন। সেই থেকেই নতুন যুগের সূচনা হলো।


ফিরে এলো ট্রাম: ১৮৮০-এর দশক থেকে ১৯০২-এর বৈদ্যুতিক ট্রামের যাত্রা

১৮৭৯ সালে ‘ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি’ নামে এক নতুন সংস্থা গঠন করা হয়। তারা নতুন করে শহরের আটটি জায়গায় ট্রামলাইন পাতার অনুমতি পায়—শিয়ালদহ থেকে বৌবাজার, ডালহৌসি, চৌরঙ্গি রোড, চিৎপুর, ধর্মতলা, স্ট্র্যান্ড রোড, শ্যামবাজার এবং খিদিরপুর। এই লাইনগুলি শহরের ব্যবসা-বাণিজ্যের মেরুদণ্ডে পরিণত হয়, কারণ এসব এলাকায় ট্রাম ছিল তখনকার প্রধান পরিবহন ব্যবস্থা।


১৯০২ সালে শহরের প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চালু হয়, যা খিদিরপুর রুটে চলতে শুরু করে। বৈদ্যুতিক ট্রাম শহরের পরিবহন ব্যবস্থায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন নিয়ে আসে। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ট্রামলাইন বাড়তে থাকে এবং সেটাই হয়ে ওঠে কলকাতা শহরের মধ্যে মূল যোগাযোগ ব্যবস্থা। ঘোড়ায় টানা ট্রামের অধ্যায় শেষ হয়।


কলকাতার সাংস্কৃতিক আইকন

যে ছবিগুলো জুড়ে জুড়ে মহানগরের কোলাজ তৈরি হয়, তাতে যেমন হাওড়া ব্রিজ থাকে, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থাকে, তেমন থাকে ট্রামও। এই ট্রাম কেবল একটা পরিবহনের মাধ্যম হয়ে থাকেনি, হয়ে উঠেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ, আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ। শুরুতে ওই যে বললাম বন্ধুদের সঙ্গে কতো আড্ডা, কতো প্রেম, ট্রামের জানলায় চোখ রেখে কলকাতার চলচ্চিত্রের কতো ছবি কতো মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে আছে ট্রাম, সেভাবেই ট্রাম উঠে এসছে সিনেমায় সাহিত্যে। সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ এর টাইটেলের সিনগুলো মনে পড়ে? সেখানে মহানগরের সঙ্গে সমার্থক হয়ে উঠেছিল ট্রাম। সত্যজিৎ রায় থেকে ঋত্বিক ঘটক, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় থেকে শংকর, উনিশ শতকের সাতের দশকের গল্পে-উপন্যাসে-চলচ্চিত্রে ট্রাম এসেছে বারবার। সেদিনের থেকে আজ, আমাদের জীবনের গতি ঠিক কতোটা বেড়েছে, যে বুড়ো থুত্থুরে হলো ট্রাম…


বুড়িয়ে যাওয়া ট্রাম: না ফুরনো গল্প

আসলে আজ কলকাতা শ্যামবাজার থেকে এসপ্ল্যানেড, শিয়ালদা-হাওড়া নয়; কলকাতা যেমন বড় হয়েছে, তেমনই কলকাতায় ভিড় বেড়েছে মানুষের, বেড়েছে যানবাহনের চাপ। এই ব্যস্ত রাস্তার মধ্যে ট্রাম ধীরগতির যান হয়ে পড়েছে। লাইন ছাড়া সে এগোতে পারেনা, তাই বাড়ছে যানজট। মানুষের হাতে আজ সময় বড়ো কম, আমাদের কলেজ-ইউনিভার্সিটির দিনগুলোর মতো আজও হয়েছে অনেকে আছে, যাঁদের কাছে ট্রাম-বিলাসের সময় আছে, কিন্তু সকলেই যে বড়ো ব্যস্ত। তাই অটো, বাস, মেট্রোই বেছে নিচ্ছেন মানুষ। শুধু আবেগ আর ইতিহাসের ঐতিহ্য নিয়ে বাস্তবতার সামনে দাঁড়ানো যায় না। তাই ধুঁকতে ধুঁকতে অবশেষে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার মুখে কলকাতার ট্রাম।


বর্তমানে কলকাতার বুকে ২ টি রুটেই চলত ট্রাম। একটি রুট ছিল বালিগঞ্জ -ধর্মতলা, অন্যটি ছিল শ্যামবাজার-ধর্মতলা। পরিবহসূত্রে জানা যাচ্ছে এই দুটি পরিষেবা বন্ধ করে, নিত্যদিনের দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য লাইনগুলোও তুলে ফেলা হবে। বদলে কলকাতার দেড়শ বছরের ইতিহাসের সঙ্গী হিসেবে, সেই ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে শুধু ধর্মতলা থেকে ময়দান পর্যন্ত পর্যটকদের জন্য চলবে একটি সুজ্জিত হেরিটেজ ট্রাম। তবে আমাদের স্মৃতিতে-ছবিতে, বইয়ের পাতায়, পুরনো সিনেমায় গানে থেকে যাবে অনেক গল্প। তেমন কোনো গল্প আছে নাকি আপনার ঝুলিতে?


history-kolkata-tram-nostalgia-journey-kolkata-news-update-tram-closed-in-kolkata

৮২৫ views৩ comments

3 則留言

評等為 0(最高為 5 顆星)。
暫無評等

新增評等
訪客
2024年9月26日
評等為 5(最高為 5 顆星)。

হমম

按讚

訪客
2024年9月25日
評等為 5(最高為 5 顆星)。

Heritage r sathr ki adhunikota k mishiye bachiye rakha jeto na tram k? Batil na kore eta k to somoy er upojogi kore tolai jeto jate tram o ajker bahon gulo r sathr palla miliye cholte pare? Bidesher ank city te ekhn street car chole jeta tram er o adhunik version. Jmn toroto city te chole streeet car

按讚

sayahna datta
sayahna datta
2024年9月25日
評等為 5(最高為 5 顆星)。

সময়ের প্রবাহে ক্রমশ আমার শহর হারিয়ে ফেলছে তার ঐতিহ্য। আমারা ব্যর্থ আমাদের পরিচয় টিকিয়ে রাখতে।😔

按讚
bottom of page