top of page
Pink Paper
Writer's pictureAnirban Das

নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়

Updated: 4 days ago

বঙ্গসংস্কৃতিতে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় একটি চিরপরিচিত চরিত্র। তারজন্য সবচেয়ে বড়ো অবদান বোধহয় গোপাল ভাঁড়ের। সহজাত কৌতুক আর বুদ্ধিমত্তার গুণে যে গোপাল ভাঁড় ছেলে থেকে বুড়ো সকলের কাছেই জনপ্রিয়। আর গোপাল ভাঁড়ের গল্প মানেই রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। সম্প্রতি ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে কৃষ্ণনগর কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের বিপক্ষে বিজেপির প্রার্থী হয়েছিলেন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির কুলবধূ অমৃতা রায়। যা সাম্প্রতিক সময়ে কৃষ্ণচন্দ্র চর্চাকে আবার উস্কে দিয়েছে। গোপাল ভাঁড়ের গল্প, কার্টুন, রাজনৈতিক কাদা ছোঁড়াছুড়ি সরিয়ে রেখে আজকের আলোচনায় আমরা ইতিহাসের পাতা থেকে খুঁজে নিতে চেষ্টা করবো রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে। দেখবো কেমন ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র? কতো বড়ো ছিল তাঁর রাজত্ব? সত্যিই কি কৃষ্ণচন্দ্রই প্রথম জগদ্ধাত্রী পুজোর সূচনা করেছিলেন? কেউ কেউ বলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র সনাতন হিন্দু ধর্মের রক্ষক, তার ধারক-বাহক; আবার কেউ বলেন তিনি বিশ্বাসঘাতক। কারণ বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার বিরুদ্ধে যাঁরা ষড়যন্ত্র লিপ্ত হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র! তিনিই নাকি মীরজাফরদের হয়ে ইংরেজদের সঙ্গে দৌত্য করেছিলেন! -এর কোনটা ঠিক, কোনটা ভুল, -মূলত এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই এগোবে আজকের আলোচনা।


অনেকেই মীরজাফরদের সঙ্গে সিরাজবিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার জন্য রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে বলে থাকেন বিশ্বাসঘাতক। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ি নতুন করে একালের রাজনীতির আঙিনায় উঠে এসে কৃষ্ণচন্দ্রকে নিয়ে প্রচলিত এই পুরনো বিতর্ককে আবার খবরের শিরোনামে তুলে এনেছে। যাঁরা কৃষ্ণচন্দ্রকে বিশ্বাসঘাতক বলেন, তাঁদের বক্তব্য কতকটা এরকম, যে বিশ্বাসঘাতকের বংশেই তো কৃষ্ণচন্দ্রের জন্ম! তাঁর বংশের গোড়াতেই রয়েছে বিশ্বাসঘাতকার এক অন্ধকার ইতিহাস। যার জন্য এখনো ‘চামে কাটা’ ভবানন্দ মুজমদারকে লোকস্মৃতি ক্ষমা করেনি। কৃষ্ণচন্দ্রের পাঁচপুরুষ আগে এই ভবানন্দ মজুমদারই নদিয়ার এই রাজপরিবারের ভিত্তিস্থাপন করেন। কেউ কেউ ভবানন্দ মজুমদারকে কৃষ্ণচন্দ্রের পূর্ববর্তী অষ্টম পুরুষ বলতে চান, তবে সেটা কৃষ্ণচন্দ্রের আগে কতোজন নদিয়ার সিংহাসনে বসেছেন তার হিসাব। সেক্ষেত্রে দেখা যাবে কারোর পুত্রদের রেষারেষিতে অনেকক্ষেত্রে ওই একই প্রজন্মের প্রত্যেকেই হয়তো কখনও না কখনও সিংহাসন দখল করেছেন। তাই প্রজন্মের হিসাবে ধরতে গেলে ভবানন্দ কৃষ্ণচন্দ্রের পাঁচ পুরুষ আগে বর্তমান ছিলেন। কথিত আছে বাংলার রাজা প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে কিছুতেই জয়লাভ করতে না পেরে, মুঘলরা অন্তর্ঘাতের পরিকল্পনায় তাঁর নিকট কিছু লোকজনের থেকে সাহায্য চান। ইতিহাসবিদরা বলেন সেইসময়ে এই ভবানন্দ মজুমদার প্রতাপাদিত্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন। এবং তিনি তৎকালীন মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের সেনাপতি মানসিংহকে প্রতাপাদিত্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জিততে সাহায্য করেছিলেন। তাই খুশি হয়ে জাহাঙ্গির ভবানন্দকে ১৪টি পরগণা উপহার দেন। আর দেন মজুমদার উপাধি। এই ভবানন্দ মজুমদারের বংশেই ১৭১০ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণচন্দ্রের জন্ম হয়। যিনি নদিয়া রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা।

তবে কৃষ্ণচন্দ্রের সিংহাসন লাভ নিয়েও একটা বিতর্ক আছে। কুমুদনাথ মল্লিকের ‘নদিয়া কাহিনী’তে এই বিষয়টির উল্লেখ আছে। কৃষ্ণচন্দ্রের পিতা রঘুরাম রায়রা ছিলেন চার ভাই, -রাজারাম, কৃষ্ণরাম, রঘুরাম আর রামগোপাল। রঘুরামের মৃত্যুর সময় কৃষ্ণচন্দ্র তখন ১৮ বছরের যুবক। হয়তো সেই কারণেই রঘুরাম কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবর্তে তাঁর বৈমাত্রেয় ভাই রামগোপালকে উত্তরাধিকারী মনোনীত করে যান। কিন্তু বিষয়টা কৃষ্ণচন্দ্রের পছন্দ হয়নি। সে যুগে নিয়ম ছিল যে উত্তরাধিকারি হবার পর ছোটো রাজারা নবাবের কাছে গিয়ে উপযুক্ত নজরানা দিয়ে, সম্মান প্রদর্শন করে নতুন করে জমিদারির ফরমান নিয়ে আসবেন৷ কৃষ্ণচন্দ্রের পিতৃব্য রামগোপাল তাম্রকূট অর্থাৎ তামাকের নেশাগ্রস্ত ছিলেন৷ তিনি যখন ফরমানলাভের উদ্দেশ্যে নবাবের প্রাসাদের দিকে যাত্রা করেছেন, তখন কৃষ্ণচন্দ্র কৌশল করে তাঁর কাকাকে তামাক সেবনে ব্যস্ত রেখে নিজে নবাবের কাছে উপস্থিত হন এবং নিজের নামে ফরমান বের করে আনেন৷ ইতোমধ্যে রামগোপালের হুঁশ ফিরলে তিনিও নবাবের কাছে গিয়ে নিজের দাবি জানান৷ কিন্তু নবাব রামগোপালের অপদার্থতার জন্য তাঁর দাবি প্রত্যাখান করে বুদ্ধিমান কৃষ্ণচন্দ্রকেই নদিয়ার পরিবর্তী রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেন৷ তারপর ১৭২৮ খ্রিস্টাব্দে ১৮ বছর বয়সে নদিয়ার সিংহাসনে বসেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়।


ব্যক্তি হিসাবে এবং রাজা হিসাবে কৃষ্ণচন্দ্র কেমন ছিলেন, -সেই বিষয়ে আলোচনা খুব একটা শোনা যায় না। আমরা তাঁকে চিনি গোপাল ভাঁড়ের গল্প আর কার্টুনের সূত্রেই। সেখানে যে নাদুস-নুদুস, নির্বিবাদী, বেচারা কৃষ্ণচন্দ্রের ছবির সঙ্গে আমরা পরিচিত, তারসঙ্গে কিন্তু ইতিহাসের কৃষ্ণচন্দ্রকে মেলানো যায় না। ছোটো থেকেই কৃষ্ণচন্দ্র ছিলেন ভীষণ মেধাবী। তখনকার দিনে, অর্থাৎ নবাবী আমলে সরকারি কাজকর্মের জন্য ফার্সি জানা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফার্সি আর সংস্কৃত -দুটি ভাষাতেই দখল ছিল কৃষ্ণচন্দ্রের। বিশ্রাম খাঁর কাছে তিনি সঙ্গীত শিক্ষাও করেছিলেন। তাঁর আমলে বড়ো কোনো যুদ্ধ সংঘঠিত না হওয়াতে যুদ্ধবিদ্যায় কৃষ্ণচন্দ্রের পারদর্শিতার কোনো গল্প শোনা যায় না, তবে কৃষ্ণচন্দ্র অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর ভাগ্নে মুজাফফার হুসেনের কাছ থেকে তিনি অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন। তাঁর কূটনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় আমরা তাঁর সিংহাসন-লাভের ক্ষেত্রেই পেয়েছি। যে বুদ্ধির বলে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র গড়ে তুলেছিলেন এক বিশাল রাজত্ব। তাঁর সময়তেই নদিয়া রাজ্যের আয়তন সবচেয়ে বড়ো আকার ধারণ করেছিল। সিংহাসনে বসার সময়ে ৩৫টি কিসমত, অর্থাৎ মৌজার অংশ ও ৪৯টি পরগণা নিয়ে নদিয়া রাজ্য গঠিত ছিল। যার বার্ষিক রাজস্ব ছিল ২৫ লক্ষ টাকা। ক্রমে তাঁর আকার দাঁড়ায় ৮৪টি পরগণায়, ৩৮৫০ বর্গক্রোশে। তখন নদিয়ার উত্তর সীমায় ছিল মুর্শিদাবাদ, দক্ষিণে গঙ্গাসাগর, পূর্বে ধুলিয়াপুর ও পশ্চিমে ভাগীরথী। কৃষ্ণচন্দ্রের প্রভাব বিস্তৃত ছিল কলকাতা পর্যন্ত।


এই বিরাট ভূখণ্ড করায়ত্ত করতে কৃষ্ণচন্দ্র যে ছল-চাতুরির আশ্রয় নেননি তা কিন্তু নয়। এই রাজবংশের দেওয়ান কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ‘ক্ষিতীশ–বংশাবলি–চরিত’-এ এই বিষয়ে প্রামাণ্য তথ্য দিয়েছেন। সেখানে একটি তথ্য রয়েছে, যে তখন হোগলকুড়িয়া, সিমলা, মৃজাপুর, বেনিয়াপুকুর, পাগলাডাঙা, ট্যাংরা -এই অঞ্চলগুলো কলকাতার একেকটা গ্রাম ছিল। যার জমিদার ছিলেন রসিক মল্লিক আর নূরজী মল্লিক নামে দুই ভাই। পলাশির যুদ্ধের বছর তিনেক আগে কলকাতার কালেক্টর হলওয়েল সাহেব ২,২৮১ টাকা দিয়ে ওই জমিগুলোর পাট্টা দুই ভাইয়ের কাছ থেকে লিখিয়ে নেন৷ তবে ইংরেজরা যখন ট্যাংরার জমি দখল করতে উদ্যোগী হয়, তখন আপত্তি জানান কৃষ্ণচন্দ্র৷ তাঁর দাবি, নূরজী মল্লিকের কাছ থেকে ওই জমি তিনি আগেই কিনে নিয়েছেন৷ প্রমাণ হিসাবে পাট্টাও দেখান তিনি৷ কিন্তু কোম্পানি ওই পাট্টা জাল বলে অগ্রাহ্য করে৷ কারণ, নূরজী মল্লিক এই ঘটনার পনেরো বছর আগেই মারা গেছেন। আর কৃষ্ণচন্দ্রের দেখানো পাট্টার তারিখ মোটে নয় মাস আগেকার৷ এরকম ঘটনা নিশ্চই আরও ঘটেছে। আরেকটা ঘটনা নবাব আলিবর্দির সময়ের। আলিবর্দির আমলে যে কৃষ্ণচন্দ্রকে নবাব হাজতে পুরেছিলেন -এই ঘটনা আমাদের সকলেরই শোনা। কারণ খাজনা দেওয়ায় কৃষ্ণচন্দ্রের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। বর্গির আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত আলিবর্দির তখন টাকার দরকার। তখন কৃষ্ণচন্দ্রের বাবার আমল থেকে দশলক্ষাধিক টাকা খাজনা বকেয়া পড়ে আছে। সিংহাসনে বসার দশ বছরেও কৃষ্ণচন্দ্র যা পরিশোধ করার আগ্রহ দেখাননি। তাই আলিবর্দি কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে ১২ লক্ষ টাকা দাবি করেন। নতুন-পুরনো হিসেব মিলিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রকে দিতে হতো তিনি সেটা করেননি। উলটে তাঁর অমিতব্যয়িতার জন্য কৃষ্ণচন্দ্রের রাজকোষেও এই পরিমাণ অর্থ ছিল না। ফলত আলিবর্দির নির্দেশে খাজনা না দেওয়ার দোষে কৃষ্ণচন্দ্র বন্দি হন। এর আগে জমিজমা সংক্রান্ত একটি ঘটনা ঘটেছিল, যার মাধ্যমে এক বিপুল সম্পত্তি করায়ত্ত করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। তখন হুগলির বংশবাটির রাজা গোবিন্দদেব প্রয়াত হলে আলিবর্দি গোবিন্দদেবের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেন৷ সেই রাজ্য দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেলে, তার একটি ভাগ গ্রাস করেন বর্ধমানের রাজা, আরেকটা অংশ কৃষ্ণচন্দ্র নিজের ছেলে শম্ভুচন্দ্রের তালুকে ঢুকিয়ে নেন। তবে কৃষ্ণচন্দ্র বলে নন, তখন রাজা, জমিদার থেকে ছোটো ভূস্বামী -এটাই আড়েবহরে বাড়ার প্রচলিত রীতি! তখনই বা বলি কেন! এখনইবা কি তার ব্যতিক্রম হয়! রাজা হিসেবে কৃষ্ণচন্দ্র নানা প্রজাহিতৈষী কাজ করেছিলেন, কিন্তু খাজনা আদায়ে তিনি বাকি পাঁচজন ভূস্বামীর থেকে আলাদা ছিলেন না। ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের আগে থেকেই বঙ্গদেশে শস্য উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছিল। ১৭৬৮তে যেমন চাষের ফসল তেমন হয়নি। পরের বছর শুরুতে ফসল ভালো হচ্ছিল কিন্তু খরার প্রভাবে সব ফসল নষ্ট হয়ে যায়। কৃষকরা বেশিরভাগই ধান গোলায় তুলতে পারেননি। ১৭৭০-এর জানুয়ারি থেকে শুরু হয় মানুষের হাহাকার। ‘ক্ষিতীশ বংশাবলী চরিত’-এ লেখক জানাচ্ছেন যে এরপর ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত নয় মাসে, বাংলার তিনভাগের এক ভাগ লোক অন্নাভাবে প্রাণ ত্যাগ করে। অথচ সেই সময় কোম্পানি ও স্থানীয় ভূস্বামীদের খাজনা আদায় যথানিয়মেই চলছিল। আসলে এবিষয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের মতো রাজাদেরকে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। কারণ তাঁরা স্বাধীন রাজা ছিলেন না। ইংরেজ প্রভুদের খাজনা দেওয়া এই ভূস্বামীদের পক্ষে ছিল বাধ্যতামূলক। নইলে তাঁদের জমিজমা নিলামে উঠতো। আর খাল কেটে বাংলায় ইংরেজদের কৃষ্ণচন্দ্ররাই এনেছিলেন। তাহলে কি সত্যিই কৃষ্ণচন্দ্র বিশ্বাসঘাতক? -এর উত্তর খুঁজতে গেলে দেখতে হবে পলাশির যুদ্ধে ঠিক কী ভূমিকা নিয়েছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র।


নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় Raja Krishnachandra Roy
নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়

আলিবর্দি খাঁ-র পর বাংলার মসনদে বসেন ২৩ বছরের যুবক সিরাজদৌল্লা। ১৭৫৬ -এর এপ্রিলে আলিবর্দি মারা যান, আর পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পতন হয় ১৭৫৭-এর জুনে। দেখতে গেলে মোটে একবছর সিরাজ রাজত্ব করেছিলেন। আসলে দোর্দণ্ডপ্রতাপ আলিবর্দির পর সকলেই চেয়েছিলেন এমন একজন শাসক যিনি দেশীয় রাজাদের স্বার্থে কাজ করবেন। কিন্তু সিরাজ সেই ছাঁচে গড়া ছিলেন না। তাই অচিরেই তাঁর বিরুদ্ধে ঘরে-বাইরে ষড়যন্ত্র শুরু হলো। কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর বাইশ বছরের মাথায় লেখা ‘মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং’ গ্রন্থে রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায় বলছেন, সিরাজের রাজদরবারের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি ছিলেন রাজা মহেন্দ্র। তিনিই প্রথম বিভিন্ন দেশীয় রাজাদের সঙ্গে মিলে সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের সলতে পাকাতে শুরু করেন। যাঁরা এই পরিকল্পনা শুরু করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন বর্ধমানের রাজা, নবদ্বীপের রাজা, দিনাজপুরের রাজা, বিষ্ণুপুরের রাজা, মেদিনীপুরের রাজা প্রমুখ। মহারাজা মহেন্দ্র এইসমস্ত রাজাদের পক্ষ থেকে শলা পরামর্শ করেন সিরাজের রাজসভা কিছু ক্ষমতাসীন ব্যক্তির সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রাজা রামনারায়ণ, রাজা রাজবল্লভ, রাজা কৃষ্ণদাস, সিরাজের প্রধান সেনাপতি বর্ষীয়ান জাফর আলি খাঁ বা মীরজাফর, ধনকুবের জগৎশেঠ প্রমুখ। তখন জগৎশেঠ প্রস্তাব দেন এই বিষয়ে নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের পরামর্শ গ্রহণ আবশ্যক। কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে দূত পাঠানো হয়। তবে প্রথমে সশরীরে না গিয়ে কৃষ্ণচন্দ্র কালীপ্রসাদ সিংহ নামে এক ব্যক্তিকে তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে পাঠান। তারপর সিরাজের সঙ্গে দেখা করার অনুমতিপ্রার্থনা করে কৃষ্ণচন্দ্র মুর্শিদাবাদ পৌঁছন। কারণ বুদ্ধিমান কৃষ্ণচন্দ্র বুঝেছিলেন, অকারণে এভাবে মুর্শিদাবাদ গেলে সেটা নবাবের সন্দেহের কারণ হবে। সিরাজবিরোধী এই গোষ্ঠীর সকলের চাইছিলেন, হয় কোনো হিন্দু রাজাকে সিংহাসনে বসানো হোক, অথবা তাঁদের অনুগত কাউকে। কিন্তু কৃষ্ণচন্দ্র প্রস্তাব দেন “বিলাতনিবাসী জাতিতে ইঙ্গরাজ কলিকাতায় কোঠী করিয়া আছেন। যদি তাঁহারা এদেশের রাজা হন তবে সকল মঙ্গল হইবে।” অর্থাৎ তিনি ইংরেজদের রাজ্যভার দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন। বিষয়টি সকলের মনঃপূত না হলেও কিছু তর্কবিতর্কের পর কৃষ্ণচন্দ্রের কথাকেই মান্যতা দেওয়া হয়। আর কথিত আছে ইংরেজদের সঙ্গে সুসম্পর্কের সুবাদে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রই সিরাজবিরোধী শিবির আর ইংরেজদের মধ্যে এই দৌত্যটি করেছিলেন। যা বাংলার সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতি -সবকিছুর মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল।  


তবে এই ঘটনায় আপনি কৃষ্ণচন্দ্রকে বিশ্বাসঘাতক বলবেন কিনা, -সেটা নির্ভর করছে, আপনি কীভাবে ইতিহাসকে দেখছেন তার উপর। আপনি যদি মনে করেন সিরাজদৌল্লা বাংলার শেষ স্বাধীন রাজা, তারপরই বাংলার ভাগ্যাকাশে ইংরেজদের ছায়া পরবর্তী দুশো বছরের অভিশাপ রূপে নেমে আসে -তাহলে এক ব্যাপার। তখন কৃষ্ণচন্দ্রকে খাল কেটে কুমীর আনার জন্য ভিলেন বলেই মনে হবে। আর আপনি যদি ভাবেন যে অত্যাচারী, বিধর্মী সিরাজের হাত থেকে বাংলাকে, সনাতন ধর্মকে বাঁচাতেই কৃষ্ণচন্দ্ররা এই পদক্ষেপ করেছিলেন, তবে আপনার মনে হবে কৃষ্ণচন্দ্ররাই ঠিক! সেটা বিচারসাপেক্ষ, যার জন্য সিরাজদৌল্লা আদতে কেমন ছিলেন -সেটাও জানা জরুরি। সেই বিচারপর্ব ভবিষ্যতের কোনো আলোচনার জন্য তোলা থাক। আপাতত আমরা এটা বোঝার চেষ্টা করি, যে আমাদের বঙ্গদেশ, বাঙালির সংস্কৃতিতে কৃষ্ণচন্দ্র এখনও কেন স্মরণীয়? শুধু কি গোপাল ভাঁড়ের জন্যই? সেটা তো হতে পারে না। তবে?


আসলে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতি গভীরভাবে ঋণী। একটু আগেই আমরা বলছিলাম যে কৃষ্ণচন্দ্র প্রচুর ব্যয়বিলাসী রাজা ছিলেন। এই ব্যয়ের একটা অংশ যেমন প্রাসাদ-অট্টালিকা-বিলাস-ব্যসনে ব্যয় হতো; তেমনই তার একটা বড়ো অংশ ব্যয় হতো ধর্মীয় উৎসবে-আয়োজনে। কৃষ্ণচন্দ্রের সময়ে ব্রাহ্মণ ও বিদ্বানদের দান-ধ্যান, মন্দির-টোল-চতুষ্পাঠী নির্মাণ -ইত্যাদিতে রাজা অকাতরে খরচ করতেন। চৈতন্য ও চৈতন্যপূর্ব যুগে বিদ্যাচর্চায় দেশের মধ্যে নদিয়ার যে গৌরব ছিল, তা পুনরুদ্ধার করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। বিক্রমাদিত্যের মতো কৃষ্ণচন্দ্রের নবরত্ন সভার কথাও আমরা শুনেছি। সেখানে গোপালভাঁড় যেমন ছিলেন, তেমনই ছিলেন সাধক কবি রামপ্রসাদ সেন, এবং মধ্যযুগের শেষ প্রতিভাবান কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। আজও রামপ্রসাদের শ্যামাসঙ্গীত আমরা শুনি বা আলোচনা হয় ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্য নিয়ে। এঁদের পাশাপাশি কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় ছিলেন পুরাণবিশারদ পণ্ডিত গদাধর তর্কালঙ্কার, সংস্কৃতজ্ঞ কালিদাস সিদ্ধান্ত ও কন্দর্প সিদ্ধান্ত, রাজজ্যোতিষী অনুকূল বাচস্পতি, রাজবৈদ্য আয়ুর্বেদাচার্য গোবিন্দরাম, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কার, কৃষ্ণানন্দ বাচস্পতি, হরিরাম তর্কসিদ্ধান্তর মতো পণ্ডিত ব্যক্তিরা। কৃষ্ণচন্দ্র গুণীর কদর করতেন। তাঁদের মাসোহারা, উৎসাহদানে কখনও কৃষ্ণচন্দ্র কার্পণ্য করেননি। তাঁর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া রামপ্রসাদ বা ভারতচন্দ্রকে আমরা কি পেতে পারতাম? কৃষ্ণচন্দ্রই নাটোরের কয়েকজন বিখ্যাত মৃৎশিল্পীকে কৃষ্ণনগরে এনে সেখানে মৃৎশিল্পের একটা ঘরানা তৈরি করেছিলেন। আজও কৃষ্ণনগরের সেই মৃৎশিল্পের খ্যাতি ভারতজোড়া।


হিন্দুধর্মের ধর্মাচারণের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। তিনি ব্যক্তিগতভাবে শাক্ত ছিলেন। তাঁর উৎসাহেই গোটা রাজ্যজুড়ে হাজার হাজার কালীপুজো শুরু হয়েছিল। কালীকে তিনি করে তুলেছিলেন ঘরের মেয়ে। বিখ্যাত শাক্তসাধক তন্ত্রাচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ তাঁর সময়েই বর্তমান ছিলেন। দক্ষিণা কালীর পুজো প্রচলন ও পুজো পদ্ধতি সংস্কারে যাঁর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। এছাড়া কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে জুড়ে আছে জগদ্ধাত্রী পুজো প্রচলনের গল্প। কয়েকমাস আলিবর্দি খাঁর কারাগারে বন্দী থাকতে হয়েছিল কৃষ্ণচন্দ্রকে। শারদোৎসবের দশমীর দিন তিনি মুক্তি পেয়ে দেখেন দুর্গাপুজো পেরিয়ে গেছে। দুর্গাপুজো না করতে পারার মনোকষ্ট ভুলতে তখন তিনি জগদ্ধাত্রী পুজোর তিথিতে মাতৃ আরাধনা করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই থেকেই কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে জগদ্ধাত্রী পুজোর শুরু। রাজবাড়ির পাশাপাশি প্রজাদেরও তিনি জগদ্ধাত্রী বন্দনায় উৎসাহ দেন। তাঁর জাঁকজমকপূর্ণ জগদ্ধাত্রী আরাধনা দেখেই দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী ফরাসডাঙা অর্থাৎ চন্দননগরে এই পুজো শুরু করেন। কৃষ্ণচন্দ্রকে অনেকেই হিন্দু ধর্মের রক্ষক হিসাবে দেখতে চান। তবে কৃষ্ণচন্দ্রও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। বিদ্যাসাগরের অনেক আগেই আমাদের সমাজে বিধবাবিবাহ প্রচলিত হতে পারতো যদি কৃষ্ণচন্দ্র বাধা না দিতেন। রাজবল্লভ বিধবাবিবাহ প্রচলনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। তিনি এজন্য কাশীর পণ্ডিত, দাক্ষিণাত্যের পণ্ডিত, সকলের কাছ থেকে অনুকূল অভিমত যোগাড় করে নবদ্বীপের পণ্ডিতদের সম্মতির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। নবদ্বীপের পণ্ডিতগণ মত দিলেই রাজবল্লভ বিধবাবিবাহের উদ্যোগ নেবেন। সেইমতো নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় দূত পাঠানো হলো। কিন্তু কথিত আছে যে কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর পণ্ডিতদের শিখিয়ে দেন, তাঁরা যাতে কোনওমতেই রাজি না হন। সেইমতো বেঁকে বসেন নবদ্বীপের পণ্ডিতরা। শোনা যায় রাজবল্লভের সেই দূতকে রান্না করা গোমাংস দিয়ে বলা হয়, হিন্দুশাস্ত্রে  গোমাংসেরও অনুমতি আছে, তাহলে তিনি সেটা খেয়ে ফেলুন। অর্থাৎ, শাস্ত্রসম্মত হলেও লোকাচার হিন্দুধর্মে বড়ো, এবং সেকারণেই বিধবা বিবাহকে আটকে দিয়েছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র। রাজবল্লভকে তিনি সহযোগিতা করেননি, অথচ ১৭৫৮ সালে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র যখন এক লক্ষ পঁচাশি হাজার টাকা বকেয়া খাজনার দায়ে গ্রেপ্তার হতে যাচ্ছিলেন, রাজবল্লভের কাছে প্রার্থনা করায় তিনি এগিয়ে এসে সেই রাজস্ব মিটিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রকে উদ্ধার করেছিলেন।


কৃষ্ণচন্দ্রের ব্যক্তিগত জীবন দেখতে গেলে মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের ছিল দুই রানী। পিতা বর্তমান থাকতে এক রানীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়, আর তারপরে যখন তিনি রাজা, তখন এক ব্রাহ্মণ কুমারীকে দেখে কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন, এবং ব্রাহ্মণের কাছে গিয়ে সেই মেয়ের পাণিপ্রার্থনা করেন। কৃষ্ণচন্দ্ররা ছিলেন কেশরকুনি। তখন কেশরকুনি, বীরভদ্রী -ইত্যাদি দোষ থাকলে, ভঙ্গ কুলীন হলে নিকষ কুলীনরা অর্থাৎ যারা খাঁটি কুলীন, তাঁরা সেই নিচু বংশে মেয়ের বিয়ে দিতেন না। দিলে তাঁদের কুলনষ্ট হতো। তাই সেই ব্রাহ্মণ তাঁদের থেকে নিচু জাতে মেয়ে দিতে অসম্মত হলেও, রাজাকে ফেরানো তো খুব একটা সহজ কথা নয়, তাই অগত্যা তিনি রাজি হলেন। এই দুই রানীর গর্ভে কৃষ্ণচন্দ্রের ছ’টি পুত্রের জন্ম হয় -শিবচন্দ্র, ভৈরবচন্দ্র, হরচন্দ্র, মহেশচন্দ্র, ঈশানচন্দ্র ও শম্ভুচন্দ্র। তবে কৃষ্ণচন্দ্রের শেষ জীবনটা সুখে শান্তিতে ভরা সংসার, রাজপাট নিয়ে কাটেনি। ঘরে-বাইরের অশান্তিতে বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছিল তাঁর জীবন। তাঁর ছেলেদের মধ্যে সম্পত্তি নিয়ে দ্বন্দ্ব চরমে উঠেছিল। বিশেষত শম্ভুচন্দ্রকে নিয়ে কৃষ্ণচন্দ্রের স্বস্তি ছিল না। কৃষ্ণচন্দ্র যখন কারারুদ্ধ, তখন এই শম্ভুচন্দ্রই পিতাকে মৃত ভেবে নদিয়ার সিংহাসনে নিজের রাজ্যাভিষেক সেরে ফেলেছিলেন। তাই তাঁকে ভরসা না করে, সকল পুত্রদের চল্লিশ হাজার টাকা করে ভাতার ব্যবস্থা করে, কৃষ্ণচন্দ্র নিজের সবসম্পত্তি শিবচন্দ্রের নামে উইল করে দেন। তবে সম্পত্তি লাভের জন্য শম্ভুচন্দ্র চেষ্টার কোনো ক্রুটি রাখেননি। এর পাশাপাশি ছিল ইংরেজদের খাজনা আদায়ের চাপ। একদিন যাঁদের কৃষ্ণচন্দ্র সাহায্য করেছিলেন, তাঁরাই ক্রমে তাঁর গলার কাঁটা হয়ে উঠেছিলেন। নিজের প্রচুর ব্যয়ের জন্য খাজনা বয়েকা থাকতো, আর তা আদায় করতে কৃষ্ণচন্দ্রের জমি নিলামে উঠতো। “প্যাদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, তাঁর নামেতে নিলাম জারি / ঐ যে পান বেচে খায় কৃষ্ণপান্তি, তারে দিলে জমিদারী।” -রামপ্রসাদের এই গানেই মেলে তাঁর প্রমাণ। এই নিলামে-নিলামেই কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বের আয়তন ছোটো হতে থাকে। চারদিকের সম্মিলিত অশান্তিতে তাই শেষজীবনে কৃষ্ণচন্দ্র কৃষ্ণনগর ছেড়ে দূরে গঙ্গার ধারে নির্জনে বসবাস শুরু করেন। সেখানেই ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে ৭৩ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। রয়ে যায় এই গল্পগুলো। যার মধ্যে আলো-অন্ধকার দুইই আছে, বিষয়টা হলো আমরা কোন দিক থেকে ইতিহাসকে দেখছি। সেখানে কেউ যেকোনো পক্ষে দাঁড়াতেই পারেন, কিন্তু ইতিহাস কারোর পক্ষে নয়, সত্য নিয়েই তার কারবার!       


ঋণস্বীকার

নদিয়ার ভাষা – দেবাশিস ভৌমিক

নদিয়া কাহিনী – কুমুদ নাথ মল্লিক

ক্ষীতিশ বংশাবলি চরিত – কার্তিকেয়চন্দ্র রায়

মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়স্য চরিত্রং – রাজীবলোচন মুখোপাধ্যায়

অন্নদামঙ্গলকাব্য – রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র

বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত – অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়

 

 

 

4 commentaires

Noté 0 étoile sur 5.
Pas encore de note

Ajouter une note
Invité
4 hours ago
Noté 5 étoiles sur 5.

Chalie jao

J'aime

Invité
3 days ago
Noté 5 étoiles sur 5.

Anabadyo

J'aime

Invité
5 days ago
Noté 5 étoiles sur 5.

তথ্যে সমৃদ্ধ

J'aime

Invité
6 days ago
Noté 5 étoiles sur 5.

Dhonyobad

J'aime
bottom of page