বাংলার ইতিহাসে মধ্যযুগের শেষ শাসক নবাব সিরাজদৌল্লা। উনিশ শতকে বাংলার নবজাগরণের সময়ে সিরাজদৌল্লাকে নিয়ে অনেক নাটক-কাব্য-কবিতা লেখা হয়েছে সিরাজদৌল্লাকে নিয়ে। যেখানে বলা হয়েছে 'পলাশির যুদ্ধে অস্ত গিয়েছিল বাংলার স্বাধীনতার সূর্য'। আর সিরাজদৌল্লা সেখানে বাঙালির এক হতভাগ্য বীর নায়ক। কিন্তু সত্যিই কি সিরাজ 'বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব'? সিরাজ কি আদৌ বাঙালি? এযুগের অনেকেই বলেন সিরাজ আসলে এক অত্যাচারী, দুর্বিনীত, উদ্ধত, নারীলোলুপ শাসক। সিরাজদৌল্লা প্রসঙ্গে বাঙালির সমাজ দ্বিধাবিভক্ত। একদল মনে করেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, রাজবল্লভরা মিলে মীরজাফর ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ক্লাইভদের সঙ্গে মিলে সিরাজদৌল্লার অপশাসনের হাত থেকে বাংলাকে বাঁচিয়েছিলেন; অন্যপক্ষের মতে পলাশির যুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকার মধ্যে দিয়েই বাংলার স্বাধীনতার সমাপ্তি ও পরবর্তী দুশো বছরের ইংরেজ শাসনের বিভীষিকার শুরু। কিন্তু ইতিহাস কী বলছে? ইতিহাসের তথ্যের ভিত্তিতে সিরাজ বাঙালির কাছে হিরো না ভিলেন? কেমন ছিল নবাব সিরাজদৌল্লার চরিত্র? সেই প্রশ্নের খোঁজেই এই আলোচনা।
সিরাজ-প্রশ্নে বাঙালি কেন দ্বিধাবিভক্ত?
স্কুল জীবনে যখন পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কে লিখতাম তখন পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা ছিল, “১৭৫৭ বাংলার স্বাধীনতা-সূর্য অস্ত গেল। পলাশীর যুদ্ধের পর বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে। শুরু হলো বাঙালির পরাধীনতার এক দীর্ঘ অধ্যায়।” আজও শচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্তের ‘সিরাজদৌলা’ নাটক পশ্চিমবঙ্গ বোর্ডের পাঠ্যক্রমে আছে। সেখানে সিরাজদৌল্লার কলঙ্ক অঙ্কিত হয়নি। মনে পড়ে আমার করা শেষ নাটকে সিরাজদৌল্লা চরিত্রেই অভিনয় করেছিলাম। তাহলে আমি কি নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করছিলাম, নাকি খলনায়কের? তখন তো জানতাম আমিই হিরো! আজও একটা বড়ো অংশের বাঙালির কাছে সিরাজ ট্রাজিক হিরো, তাদের মনে সিরাজের প্রতি সহানুভূতি আছে, সিরাজ তাদের কাছে ‘বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব’। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? কারণটা আগেই উল্লেখ করেছি, উনিশ শতক থেকে বহু গল্পে-নাটকে-গানে-কবিতায় বারবার উঠে এসেছে সিরাজদৌল্লা প্রসঙ্গ। তখন বাঙালি আদর্শ চরিত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে, যে চরিত্র সাধারণ মানুষের ব্রিটিশবিরোধিতাকে উস্কে দিতে পারবে, পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচনে তাকে উৎসাহ দিতে পারবে, এই খোঁজ থেকেই তুলে আনা হয় প্রতাপাদিত্যকে, আবার সিরাজদৌল্লাকেও। সিরাজদৌল্লার জায়গাটা পাকাপোক্ত হয় কারণ তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি আমরণ ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন। তিনি ব্রিটিশদের ষড়যন্ত্রের শিকার। আর পলাশির যুদ্ধে সিরাজের পরাজয়ের পরই বাংলার ক্ষমতা ইংরেজদের কুক্ষীগত হয়। তাই বাঙালির নবজাগরণের যুগে, জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনা উন্মেষের যুগে বহু সাহিত্যিক সিরাজকে ব্রিটিশবিরোধী এক ভাগ্যবিড়ম্বিত নায়ক হিসেবে তুলে ধরছেন। কিন্তু এই একই সময় দাঁড়িয়ে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো পণ্ডিত সে পথে হাঁটেননি। যেমন ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’-এ বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘‘সিরাজউদ্দৌলা, সিংহাসনে অধিরূঢ় হইয়া, মাতামহের পুরাণ কৰ্ম্মচারী ও সেনাপতিদিগকে পদচ্যুত করিলেন। কুপ্রবৃত্তির উত্তেজক কতিপয় অল্পবয়স্ক দুষ্ক্রিয়াসক্ত ব্যক্তি তাঁহার প্ৰিয়পাত্র ও বিশ্বাসভাজন হইয়া উঠিল। তাহারা, প্ৰতিদিন, তাঁহাকে কেবল অন্যায্য ও নিষ্ঠুর ব্যাপারের অনুষ্ঠানে পরামর্শ দিতে লাগিল। ঐ সকল পরামর্শের এই ফল দর্শিয়াছিল যে, তৎকালে, প্ৰায় কোনও ব্যক্তির সম্পত্তি বা কোনও স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই।” অর্থাৎ বিদ্যাসাগরের কথা মতো সিরাজ ‘স্বেচ্ছাচারী’, ‘নির্বোধ’, ‘অত্যাচারী’, ‘লম্পট’! -সিরাজকে নিয়ে এই যে ভালোমন্দের দুটো দিক, এখান থেকেই প্রশ্নটা আরও জোরালো হয়ে ওঠে যে কোনটা ঠিক? এই প্রসঙ্গে আসবো তবে, সিরাজকে নিয়ে আলোচনায় অনেকে তাঁকে ‘বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব’ বললে প্রথমেই যে আপত্তিটি তোলেন, “আরে মশাই, সিরাজ তো বাঙালিই নয়!” সত্যিই কি তাই? -এখান থেকে শুরু করি বরং।
সিরাজদৌল্লা বাঙালি?
সিরাজ বাঙালি ছিলেন কিনা -এর সরাসরি উত্তর ‘না’। সিরাজের জন্ম হয়েছিল এই বাংলায়, কিন্তু সেকালে খাওয়া-পরা-আচার-আচরণে বঙ্গদেশের মানুষ যেমন ছিলেন, তার সঙ্গে নবাব আলিবর্দি খাঁ-এর নাতি ও পরবর্তীকালে নবাব সিরাজদৌল্লার যৎসামান্যই মিল ছিল। সিরাজের দাদু আলিবর্দি বাংলায় এসেছিলেন ১৭২০ নাগাদ। শোনা যায় আলিবর্দির ঠাকুরদা ছিলেন ঔরঙ্গজেবের সৎভাই। শোনা যায় বললাম কারণ এই তথ্যটা বহু জায়গায় দেখলাম, কোনো অথেন্টিক সোর্স থেকে যাচাই করা হয়নি। তবে আলিবর্দীর বাবা-মা উভয়ই জাতিতে তুর্কি ছিলেন। সিরাজ বাংলা জানতেন কি জানতেন না -এ বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য নেই, তবে সেযুগে যেহেতু বহু বাঙালি জমিদার ও রাজকর্মচারি ছিলেন, যেকোনো বুদ্ধিমান ব্যক্তিই নিজের সুবিধার্থে বাংলা শিখবেন, কিন্তু সিরাজের মাতৃভাষা এবং প্রথম ভাষা কোনোটাই বাংলা ছিল না। কারণ তাঁর ব্যক্তিগত পারিবারিক চিঠিপত্র সম্পর্কে যেটুকু জানা যায়, তাতে তিনি বাংলাতেই লিখতেন। তাই সিরাজকে বাঙালি বলা যায় না। কিন্তু বাঙালি না হলে কেউ কি বাংলার হতে পারেন না? বিদ্যাপতি বাঙালি নন, বেথুন-ডিরোজিও বাঙালি নন, ভগিনী নিবেদিতাো বাঙালি নন, তবু বাঙালি তাঁদের মাথায় করে রেখেছে। তাহলে সিরাজ বাঙালি না হন, যদি তিনি বাংলার জন্য প্রাণ দিয়ে থাকেন, তবে তাঁকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বলতে আপত্তি কোথায়? -এই প্রশ্নের উত্তর পেতে গেলে প্রথমে আমাদের জানতে হবে ইংরেজদের বিরুদ্ধে সিরাজ কেন যুদ্ধ করেছিলেন বা ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের সংঘাতের কারণ কী? সেখানে কি বাংলার নায়ক রূপে বিকশিত হওয়ার জন্য সিরাজের চরিত্রের কোনো দিক উঠে আসছে?
ইংরেজদের সঙ্গে সিরাজের দ্বন্দ্বের প্রকৃত কারণ কী?
ইংরেজদের সিরাজ দু’চোখে দেখতে পারতেন না, আলিবর্দী বেঁচে থাকতেই তিনি বারবার দাদুর কাছে তদ্বির করেছেন ইংরেজদের শায়েস্তা করার জন্য দেশ থেকে বিতাড়িত করার জন্য। এবং নবাব হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত ইংরেজদের দমন করতেই সচেষ্ট থেকেছেন, পারেননি। -এই সবই ইতিহাসসম্মত। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে সিরাজের সঙ্গে ইংরেজদের দ্বন্দ্বের কারণ কী? তা কী নেতাজি-ক্ষুদিরামদের মতো দেশপ্রেম, দেশমাতৃকাকে, দেশের মানুষকে রক্ষা করার জন্য? নাকি অন্য কিছু?
২৩ বছর বয়সে বাংলার মসনদে বসেছিলেন সিরাজদৌল্লা। তার আগে সিরাজের বয়স যখন ১৭ বছর, সেই সময়ে আলিবর্দি সিরাজকে পরবর্তী নবাব বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন। সিরাজ যখন আলিবর্দির জায়গায় বসবেন তখন বাংলা আর আগের মতো নেই। তখন উড়িষ্যা আর বিহারের কিছু অংশ বর্গিদের সঙ্গে আলিবর্দির চুক্তির জন্য তাঁর হাত থেকে বেরিয়ে গেছে। পূর্ণিয়ায় রাজত্ব করছেন সৈয়দ আহম্মদ, তাঁর পর আসবেন শওকত জঙ্গ যিনিও সিরাজের পক্ষে নন, তিনি নবাবের সিংহাসনের দাবিদার। ঢাকা পুরোপুরি রাজবল্লভের অধীনে, যিনি সিরাজ-বিরোধী ঘষেটি আর তাঁর স্বামী নওয়াজিসের অনুগামী। রানী ভবানী সহ হিন্দু ভূস্বামীরা কেউই তাঁর পক্ষে নেই। পড়ে আছে শুধু মুর্শিদাবাদ। অর্থাৎ খুব সুস্থির পরিস্থিতে সিরাজ নবাব হননি। তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর চারদিকে ষড়যন্ত্র, দেখতে পাচ্ছিলেন আলগা হয়েছে কেন্দ্রীয় শাসনের মুঠো। এই অবস্থায় তাঁর প্রয়োজন ছিল শক্তশালী শাসক হিসেবে আলিবর্দির মতো একটা ভাবমূর্তি তৈরি করা। আর তাঁর মনে একটা নিরাপত্তাহীনতাও ছিল। ‘আমি নবাব’ এটা যেন তিনি সবাইকে বুঝিয়ে দিতে চাইতেন। একটা ঘটনা থেকেই যার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
আলিবর্দির আমলে নবাবের অধীনস্থ জমিদাররা স্বাধীনভাবেই ছিলেন, আলিবর্দি তাঁদের রাজত্ব বা জমিদারির ভিতর নাক গলাতেন না, কেবল খাজনাটা বুঝে নিতেন। আলিবর্দিকে সকলেই সমীহ করতেন, তাই ‘আমি নবাব, আমার অনুগত থাকো’ -বারবার এরকম আনুগত্য আদায়ের তাগিদ আলিবর্দি অনুভূত করেননি। কিন্তু সিরাজকে যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠই পছন্দ করতেন না, তাই আলিবর্দির স্থানটা সিরাজ পাননি। সেজন্য সিরাজ সবাইকে বশ্যতা স্বীকার করাতে চাইতেন। তখন বর্গিদের আক্রমণের জন্য অনেকেই কলকাতাতে পারিবারিক আশ্রয়ের জন্য রাজবাড়ি বানিয়েছেন। তেমনই করেছিলেন বর্ধমানের রাজা। একবার ইংরেজরা অন্যায় ভাবে বর্ধমান রাজের কলকাতার রাজবাড়িটি দখল নিলে, বর্ধমান-রাজও বর্ধমানে ইংরেজদের যাবতীয় বাণিজ্য বন্ধ করে দেন। আলিবর্দি নবাব থাকলে এই বিষয়ে তিনি হস্তক্ষেপ করতেন না, বা বর্ধমান-রাজের বিপক্ষে যেতেন না। কারণ আলিবর্দি বুঝতেন এই ভূস্বামীদের গুরুত্ব। কিন্তু সিরাজ তো আলিবর্দি নন! তাই ইংরেজরা নবাবের দরবারে এই বিষয়ে নালিশ করলে সিরাজ বর্ধমান-রাজকে বললেন, নিজে বর্ধমানে ইংরেজদের বাণিজ্য বন্ধ করার উদ্যোগ না নিয়ে, তাঁর উচিত ছিল নবাবের কাছে অভিযোগ জানানো। তাই সিরাজ ইংরেজদের বাণিজ্য করতে দেওয়ার আদেশ দিলেন। অবাক লাগতে পারে যে ইংরেজবিরোধী সিরাজ হঠাৎ এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিলেন কেন? ন্যায়সঙ্গত বলে? -না। আসলে এখানে তিনি ইংরেজদের পক্ষ নেননি, তিনি বর্ধমান-রাজের ডানা ছাঁটতে চেয়েছিলেন।
পূর্ববর্তী প্রসঙ্গে ফিরি। তাঁর নবাব সত্তাটি যাতে কোনো ভাবে অপদস্ত না হয় তা নিয়ে সিরাজের একটা নিরাপত্তাহীনতা ছিল। যে জায়গাতে আঘাত করেছিলেন ইংরেজরা। সিরাজের মনে হচ্ছিল যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও ইংরেজরা তাঁকে মান্য করছেন না। তবে কোম্পানি কিন্তু একাধিকবার সিরাজকে নজরানা দিয়ে, বিশাল অঙ্কের উপহার দিয়ে আনুগত্য প্রদর্শনের চেষ্টা করেছে। কিন্তু সমস্যাটা ছিল অন্য জায়গায়। অর্থনীতিতে। যেহেতু সারা বাংলা জুড়ে সিরাজ ভূস্বামীদের সমর্থন পাননি, তাঁর টাকা-পয়সার ঘাটতি ছিল। তার উপর ইংরেজদের থেকে তাঁর রাজস্বের ক্ষতি তিনি মানতে পারছিলেন না। এর শুরু আলিবর্দি বেঁচে থাকতেই। তখন সিরাজ নবাব নন, নিয়মিত একটা ভাতা পান। আলিবর্দির কাছে আবদার করে সিরাজ তাঁর সাধের হীরাঝিল প্রাসাদ নির্মাণ করার পর, টাকাপয়সার আমদানি বাড়াতে একটা বাজার বসিয়েছিলেন, মনসুরগঞ্জ। যে বাজারের পুরো রাজস্ব তাঁর হস্তগত হতো। সেখানে বিদেশীরাও বাণিজ্য করতো। কিন্তু সিরাজের ফরাসি-ওলন্দাজদের নিয়ে কোনো সমস্যা ছিল না কারণ তাঁরা ট্যাক্স দিত। কিন্তু কোম্পানির কাছে ছিল বাদশার বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার ফরমান। এবং শুধু কোম্পানিই নয়, অন্যান্য ইংরেজরাও সেই ফরমানের অপব্যবহার করে বিনাশুল্কে বাণিজ্য করতো। ফলে সিরাজের অর্থনৈতিক ক্ষতি হতো, তাই তখন থেকেই তিনি ইংরেজদের বিরুদ্ধে আরও বিরূপ হয়ে ওঠেন।
সিরাজদৌল্লা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব?
এরপর সিরাজ নবাব হলে কোম্পানির সঙ্গে বারবার সিরাজের যে সমস্যা তৈরি হয়, তার মূল কারণ দুটো- একটা দস্তকের অপব্যবহার জনিত সিরাজের অর্থনৈতিক স্বার্থের ক্ষতি, আর দুই ‘জো-হুজুর’ বলে সিরাজের আদেশ-নির্দেশ কোম্পানির না মেনে নেওয়া। সেই থেকেই ইংরেজ ও সিরাজের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। যার পরিণাম পলাশীর ষড়যন্ত্র। ইতিহাসে সব রাজাই নিজের রাজত্বকে নিজের সার্বভৌমত্বকে বাঁচাবার জন্য লড়েছেন। প্রতাপাদিত্য মুঘলদের কবল থেকে তাঁর ভূখণ্ডের স্বাধীনতার জন্য লড়েছেন, আলিবর্দি মারাঠাদের লুঠপাটের হাত থেকে বঙ্গদেশকে রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু সিরাজ পঞ্চাশ হাজার সৈন্য নিয়ে পলাশিতে যে ব্রিটিশদের তিন হাজার সৈন্যের সামনে দাঁড়ালেন, যেখানে নবাবি সৈন্যরা খালি হাতে যুদ্ধ করে ইংরেজদের মাটিতে মিশিয়ে দিতে পারতো, সেই যুদ্ধে সিরাজ কি ইংরেজদের হাত থেকে বাংলাকে বাঁচানোর জন্য লড়তে গেছিলেন, নাকি নিজের ইগো তাঁকে একলা-শক্তিহীন করে দাঁড় করিয়েছিল পলাশীর প্রান্তরে? এর উত্তর আমি পাঠকের বিবেচনার জন্য রাখছি। আর আমরা যে প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলাম, যে সিরাজ কি বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব - সেখানে ফিরে আসি।
টেকনিক্যালি উত্তর দিলে এর উত্তর হবে ‘না’। কারণ নবাবী আমলে বাংলা স্বাধীন ছিল না। বাংলা থেকে নিয়মিত রাজস্ব যেত দিল্লির বাদশার কাছে। বাংলার নবাবরা ঠিক সময়ে রাজস্ব পাঠাতেন না, সেটা আলাদা ব্যাপার। তাঁরা বাদশাহকে মান্য না-ই করতে পারেন, অগ্রাহ্য করতে পারেননি। তাই বাদশার সনদ বা অনুমতিপত্র নিয়েই আলিবর্দি সিংহাসনে বসেছিলেন। কিন্তু সিরাজের কাছে সনদ ছিল না। যদি বলতে পারতাম যে সিরাজ সনদ-টনদের তোয়াক্কা না করে, স্বাধীনতা ঘোষণা করে সিংহাসনে বসেছিলেন তবে সিরাজকে নবাবি আমলের প্রথম ও শেষ স্বাধীন রাজা বলা যেত, কিন্তু সিরাজ সেই অনুমতিপত্র পাননি। কারণ দিল্লির দরবারে সিরাজের কোনো সোর্স ছিল না, একাজে তাঁকে সাহায্য করতে পারতেন জগত শেঠরা, কিন্তু জগত শেঠদের সম্মিলিত বিরূপতায় সিরাজ তা পাননি। এই নিয়ে তাঁর মনে ক্ষোভও ছিল। পরে তাঁর ভাই (মাসির ছেলে) শওকত জঙ্গ বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাব হবার অনুমতিপত্র পান। তাই সিরাজকে “বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব” তকমা দেওয়াটা সমীচীন হবে না।
এবার বিষয়ান্তরে আসি, সিরাজের বিরুদ্ধে যে প্রশ্নগুলো উঠছে তাঁর চরিত্রকে কেন্দ্র করে, স্বয়ং বিদ্যাসাগরও যেকথা বলেছেন, সেগুলো কি ইতিহাসসম্মত?
কেমন ছিল সিরাজের চরিত্র?
আলিবর্দির বংশে পুত্র ছিল না। তাঁর তিন মেয়ে মেহেরুন্নিসা যাঁকে আমরা ঘষেটি নামে চিনি, মুনিরা ও আমিনা বেগম। তাঁর বড়ো ভাইয়ের ছেলেদের সঙ্গে আলিবর্দি এঁদের বিয়ে দিয়েছিলেন। এরমধ্যে আমিনা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল জৈনুদ্দীনের। সিরাজ তাঁদেরই ছেলে। স্বাভাবিকভাবেই বংশের প্রথম ছেলে হিসাবে সিরাজ ছোটো থেকেই দাদু আলিবর্দি আর দিদিমা শরফ-উন্নিসার ভীষণ আদরের ছিলেন। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো আলিবর্দি-পত্নী শরফ-উন্নিসা বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। তিনি অন্তপুরিকার মতো প্রাসাদে নিজেকে বদ্ধ না-রেখে আলিবর্দির সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতেন। আলিবর্দি সব কাজে তাঁর পরামর্শ নিতেন। ছোট্ট সিরাজের কোনো চাহিদারই অভাব রাখেননি তাঁর দাদু-দিদিমা। তিনি যা চাইতেন তা-ই পেতেন। ফলত আদরে বাঁদর হওয়া যাকে বলে সিরাজ ছোটোবেলা থেকে তেমনই হয়ে উঠেছিলেন। আলিবর্দি সংযত জীবনযাপন করলেও সিরাজ তাঁর আশপাশ দিয়েও জাননি। ১৮ বছর পেরোলে আমরা সাধারণত কাউকে যুবক বলে থাকি, তবে ১৫ বছরের আগেই বিলাস-ব্যসন, আমোদ-প্রমোদে ডুবে গিয়েছিলেন সিরাজ। সুরা আর নারীতে আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেকালের অভিজাত পরিবারে এসব কিছুর রাখ-ঢাক ছিল না। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের মাত্র ২৫ বছর বয়সে ছিল ২০ জন স্ত্রী আর তিনশোরও বেশি দাসী। আলিবর্দি ব্যতিক্রম হতে পারেন কিন্তু সিরাজ এই ধারার ব্যতিক্রম নন। বছর ১৫ বয়সে তাই আলিবর্দির মহল থেকে তাঁর আলাদা প্রাসাদের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সম্মতি দেন আলিবর্দি। তৈরি হয় হীরাঝিল। সিরাজের প্রমোদ-স্বর্গ। সিরাজ আরও বেলাগাম হন। রাশ টানেননি আলিবর্দিও। এমনকি একবার সিরাজ আলিবর্দির বিরুদ্ধেই বিদ্রোহ করে বসেন, সেটাও নাতি ছেলেমানুষি ভেবে উড়িয়ে দেন আলিবর্দি। ঘটনাটা এরকম, সিরাজের বাবা ছিলেন পাটনার নাজিম। আফগানদের হাতে তিনি নিহত হলে, আমিনা বেগম বন্দি হলে আলিবর্দি পাটনা অভিযানে গিয়ে, পাটনার নিয়ন্ত্রণ হাতে নিয়ে আলিবর্দি সিরাজকে পাটনার নামমাত্র নবাব করে, মূল কার্যভার দেন তাঁর বিশ্বস্ত প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণবঙ্গীয় কায়স্থ জানকীরামকে। বিষয়টা সিরাজের পছন্দ হয়নি। আলিবর্দির নির্দেশে মুর্শিবাদ ফিরে গেলেও তিনি পুনরায় পাটনা এসে জানকীরামকে সরিয়ে নিজে রাজ্যের প্রকৃত শাসক হতে চান। কিন্তু জানকীরাম নবাবের আদেশ ব্যতীত এই কাজে রাজি না হয়ে সিরাজকে সেই সংবাদ পাঠিয়ে দুর্গের দ্বার রুদ্ধ করে দেন। সিরাজ ক্ষেপে উঠে দুর্গে তোপ-টোপ দেগেও কিছু করতে না পেরে, আলিবর্দিকে ‘হয় আমি থাকবো, নয় তুমি থাকবে’ -এরকম ধরনের একটি চিঠি লিখে বসেন। ছুটে আসেন আলিবর্দি। কিন্তু সিরাজকে শাসন করা দূরের কথা, তাঁকে বুকে টেনে তিনি সিরাজকে পরবর্তী নবাব ঘোষণা করে দেন। এরকম আস্কারা পেলে বাংলার নবাব আলিবর্দির আদরের দুদাল সিরাজ যা ইচ্ছা তাইই করবেন -এ খুব স্বাভাবিক! আর একাজে উৎসাহদানের জন্য মোসাহেবও তাঁর জুটেছিল। এদিক থেকে বিদ্যাসাগরের কথা ঠিক। কিন্তু বিদ্যাসাগর যে বলেছিলেন, “তৎকালে… কোনও স্ত্রীলোকের সতীত্ব রক্ষা পায় নাই।” -এটা কতোদূর সত্যি?.....
.
সেকালে রাজশাহীর জমিদারি ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো জমিদারি ছিল। যার মাথায় ছিলেন রানী ভবানী। রানী ভবানী গল্প করার মতো এক চরিত্র, একদিন তাঁকে নিয়ে গল্প হবে। এখন যে জন্য এই প্রস্তাব উত্থাপন করলাম সেটাই বলি। রানী ভবানীর এক অপরূপ রূপসী বালবিধবা কন্যা ছিল, তারা। সিরাজের নজর পড়েছিল তাঁর উপর। তখন যুবরাজ হিসেবে তাঁর রাজ্যাভিষেক হয়ে গেছে। তিনি জানেন কিছুই তাঁর না-পাওয়া নেই। আশঙ্কায় কী করা যায় ভেবে, রানী ভবানী মিথ্যা চিতা জ্বালিয়ে মেয়ের মৃত্যু সংবাদ রটালেন। কিন্তু এভাবে কতদিন? এই মিথ্যে খবর সিরাজের কাছে পৌঁছলে কি রক্ষে থাকবে? সকলে প্রমাদ গুনলেন। রানী ভবানী সেসময়ে হিন্দু সমাজের কাছে পরম পূজনীয় হয়ে উঠেছেন। তাই হিন্দুর সমাজ ত্রাহী ত্রাহী করে উঠলো। আর সিরাজের বিরুদ্ধে জনমত তৈরি করতে এই বিষয়টিকে সামনে রাখলেন জগৎশেঠরা। কারণ আর যাই হোক, নারীর সম্মানের বিষয় বাঙালি চিরকাল স্পর্শকাতর। বাস্তবে সিরাজ তারার অনিষ্ট করার সুযোগ পাননি, কিন্তু সিরাজে রাজত্বে কোনো নারীই সুরক্ষিত নয় -এই ডায়লেক্টটা তৈরি হয়ে গেছিল। পলাশির যুদ্ধের পর আমরা পাবো তাঁর এক্সটেনডেড ভার্সন। ১৮৬৯-এ প্রকাশিত ভোলানাথ চন্দ্রের ‘Travels of A Hindoo’-তে তিনি সিরাজ সম্পর্কে লিখেছেন, “এই সিরাজদৌল্লা গর্ভস্থ সন্তান কীরূপে বাস করে তাহা দেখিবার জন্য গুর্ব্বিণীর উদর বিদীর্ণ করিত, রাজপ্রাসাদে বসিয়া মুমুর্ষুর অঙ্গবিক্ষোভ দেখিয়া আনন্দলাভের জন্য নৌকামধ্যে নরনারী আবদ্ধ করিয়া নিমজ্জিত করিবার আদেশ দিত; কক্ষমধ্যে উপপত্নীগণকে ইষ্টকদ্বারা জীবিতাবস্থায় সমাধি-নিবদ্ধ করিত; মাতার পর-পুরুষ সম্ভোগের প্রতিশোধ লইবার জন্য রমণীমাত্রেরই সতীত্বনাশ করিত; তরবারী ও বর্শাধারিণী তাতার, জর্জিয়া ও হাবসীদেশের রমণীগণকে অন্তঃপুরের দ্বাররক্ষায় নিযুক্ত রাখিত; মুর্শিদাবাদের প্রকাশ্য রাজপথে নরহত্যা করিত; বহুরমণী সম্ভোগ করিয়া এবং নরহত্যায় পুণ্যলাভ করিয়া মহম্মদের মতের দুটি প্রধান উপদেশ পালন করিয়া মোসলমান চরিত্রের আদর্শ রূপে প্রতিভাত হইত।” শুনে শিউরে উঠতে হয়! পলাশির যুদ্ধর ১০০ বছর পর ভোলানাথ এই তথ্য পেলেন কোত্থেকে? সৌজন্যে রোজার ড্রেক। যিনি সিরাজের সময়ে ফোর্ট উইলিয়ামের গর্ভর্নর ছিলেন। ড্রেকরা বাদশার দস্তকের অপব্যবহার করলেও অলিবর্দি সেদিকে নজর দেননি, এড়িয়ে গেছিলেন, কিন্তু সিরাজ এবিষয়ে কঠোর হন এবং ড্রেককে নির্দেশ দিলেও, ড্রেক কর্ণপাত করেননি। তখন সিরাজ কলকাতা আক্রমণ করেন। এর দুদিনের মাথায় ১৮ জুন ১৭৫৬-এ রোজার ড্রেক পালিয়ে কাপুরুষের মতো তাঁর লোকজনদের ফেলে রেখে পালিয়ে যান। এই জন্য পলাশির যুদ্ধের পর তাকে কোর্ট অফ ডিরেক্টরস থেকে সরিয়ে প্রথমে উইলিয়াম ওয়াটস্-কে পরে রবার্ট ক্লাইভকে নিয়ে আসা হয়। পরে ইংল্যান্ডে নিজের কৃতকর্মের কারণ ব্যখ্যা করতে গিয়েই সিরাজের চরিত্র সম্পর্কে নানা কথা বলেন, যেখান থেকে চন্দ্রনাথ এই তথ্য নিয়েছিলেন। এবং তারপর এই তথ্যগুলো রাষ্ট্র হয়ে যায়। কিন্তু অষ্টাদশ শতকের অন্য কোনো ডকুমেন্টেই এই তথ্যের পুনরুল্লেখ আমি অন্তত পাইনি। যেখানে সিরাজকে মদ্যপ, উদ্ধত, অসংযত, নারীলোলুপ হিসেবে দেখানো হয়েছে সেখানেও এই তথ্য নেই। তাই আপনাদের কাছে এরকম কোনো অথেন্টিক সূত্র থাকলে দৃষ্টি আকর্ষণ করার অনুরোধ রইল। অর্থাৎ সিরাজ দুর্বিনীত, উদ্ধত, মদ্যপ ছিলেন, নারীর প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল -এর ঐতিহাসিক প্রমাণ থাকলেও গর্ভচিরে গর্ভস্থ সন্তান দেখা -ইত্যাদি কোনো প্রমাণ আমাদের হাতে এখনও পর্যন্ত নেই।
সিরাজের পাপ
সিরাজের চরিত্রের আরও দুটি কলঙ্ক নৃশংসভাবে হোসেন কুলিকে হত্যা করা আর অন্ধকূপ হত্যা। নিজের রাস্তা কণ্টকমুক্ত করতে হোসেন কুলিকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলেন সিরাজ। তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে হাতির পিঠে নগরে ঘোরানো হয়েছিল যাতে সিরাজের বিরোধিরা শিক্ষা নেন। বিষয়টা এরকম যে, আলিবর্দির বড়ো মেয়ে ঘষেটি বেগমের বিয়ে হয়েছিল আলিবর্দির ভাতুষ্পুত্র নওয়াজিস মুহম্মদ শাহমাত জং-এর সঙ্গে। নওয়াজিস ও ঘষেটির কোনো সন্তান ছিল না। তাঁরা থাকতেন মতিঝিল প্রাসাদে। আলিবর্দির জীবনদীপ ক্রমে অস্তমিত হয়ে এলে মতিঝিলের গুরুত্ব বাড়তে শুরু করে। নওয়াজিস দান-ধ্যানে বহু অর্থ অকাতরে বিলোতেন। তাই সকলের গন্তব্য ছিল মতিঝিল। সেসময়ে একদিকে সিরাজের বদনাম যেমন দুর্নাম ছড়াচ্ছিল, তার বিপরীতে প্রভাবশালী হচ্ছিলেন নওয়াজিস। সাধারণ থেকে অভিজাত সকলের মধ্যেই নওয়াজিস সীমাহীন প্রভাববিস্তার করেছিলেন। এমতাবস্থায় আলিবর্দী দেহ রাখলে নবাব হতেন নওয়াজিসই। যা দেখে প্রমাদ গোনেন সিরাজ। এই নওয়াজিসের দুই বিশ্বস্ত অনুচর ছিলেন ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভ আর হোসেন কুলি। রাজবল্লভ নওয়াজিসকে দিতেন অর্থের জোগান আর হোসেন কুলির উপরেই ছিল নওয়াজিসের কোষাগারের ভার। সিরাজ এঁদের শায়েস্তা করার একটা পথ খুঁজছিলেন। এমন সময়ে ঘষেটি আর হোসেন কুলিকে নিয়ে নানা চর্চা গুঞ্জরিত হতে থাকে। পারিবারিক ভাবমূর্তির কথা ভেবে সিরাজের দিদিমা তাঁকে এর প্রতিকার করতে বললে, সিরাজ সুযোগ বুঝে হোসেন কুলিকে নির্মমভাবে হত্যা করান। কিন্তু আলিবর্দি বা নওয়াজিস কেউই এর বিরুদ্ধে কিছুই বলেননি। কেন বলেননি সেটা অনুমান করা যায়। তবে নওয়াজিস আলিবর্দির জীবদ্দশাতেই গত হন। তাঁর আর নবাব হওয়া হয়নি, এরপর ঘষেটি ও রাজবল্লভরা আলিবর্দির দ্বিতিয় মেয়ে মুনিরা বেগমের পুত্র শওকত জঙ্গকে সিংহাসনে বসানোর উদ্যোগ নেন। যে শওকত জঙ্গ নবাব হবার বৈধ সনদ পেয়েছিলেন। সিরাজ দৌল্লার আরেকটি কলঙ্ক অন্ধকূপ হত্যা। কিন্তু অন্ধুকূপ হত্যার মতো ভয়াবহ আর বিকর্তিত বিষয় নিয়ে এক-দু’কথায় বলে ওঠা যাবে না। অন্য একদিন সেকথা হবে। আপাতত এই আলোচনায় ইতি টানি একটা উপসংহারের মধ্যে দিয়ে যে, তাহলে আমরা কী সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম, সিরাজ হিরো নাকি ভিলেন?
শেষকথা
দেখুন যদি প্রশ্ন হয়, সিরাজ বাঙালি ছিলেন? তার উত্তর না। সিরাজকে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব বলা যায়? তার উত্তরও টেকনিক্যালি না। সিরাজ মদ্যপ, অর্থলোলুপ, নারীলোলুপ, উদ্ধত, দুর্বিনীত ছিলেন? -এর সমর্থন ইতিহাসে মেলে। তাঁর সময়ে কি সত্যিই বাংলার প্রজা ও নারীরা অসুরক্ষিত হয়ে পড়েছিল? বা তিনি নির্বিচারে গণহত্যা করেছেন -এর সপক্ষে কোনো প্রমাণ আমরা দিতে পারিনা। এখন প্রশ্ন হলো তিনি বাংলার জন্য তিনি কী করেছেন? সিরাজের রাজত্বকাল মাত্র পনেরো মাসের। যারমধ্যে বেশিরভাগ সময় তাঁর বিদ্রোহী দমন আর যুদ্ধ করতে করতেই কেটে গেছে। তিনি রাজ্যশাসনের অবকাশ পাননি। পলাশীর যুদ্ধ না হলে, সেই অবকাশ পেতেন কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। কারণ আলিবর্দির মতো নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা তাঁর ছিল না। দীর্ঘদিন আলিবর্দির সঙ্গে থাকলেও সেই বিচক্ষণতার পরিচয় তিনি দেখাতে পারেননি। অর্থ ও বাহুবলে সিরাজ বাংলার মসনদে দীর্ঘদিন টিকতে পারতেন না, তাঁর প্রয়োজন ছিল কূটনৈতিক বুদ্ধি। পনেরো মাসে সেই কূটকৌশল আমরা দেখিনি। তবে পলাশির প্রান্তরে পঞ্চাশ হাজারের বেশি সৈন্য নিয়েও তিনি একলা হয়ে যেতেন না, নির্বান্ধব হয়ে যেতেন না। এদিক থেকে তিনি ব্যর্থ। তাই তিনি কী করতে পারতেন সেই বিষয়ে আলোচনা অর্থহীন। আমার মতে সিরাজ বাঙালির নায়ক নন, খলনায়কও নন। বাকি পাঁচজন শাহজাদা বা রাজকুমার বা অভিযাতসন্তানের মতো এক যুবক। ভাগ্য যার সঙ্গ দেয়নি। পলাশির যুদ্ধের পর বাংলার রাজনৈতিক পালাবদল না হলে, দুশো বছরে ব্রিটিশদের হাতে সোনার বাংলা ছারখার না হয়ে গেলে, দেশের মানুষ ত্রাহি ত্রাহি না করলে পলাশির যুদ্ধকে মানুষ মনে রাখতো না, সিরাজকেও রাখতো না। এখানে হিন্দু-মুসলমান কোনো ইস্যু নেই। অষ্টাদশ শতকে আপনি দেখবেন, আফগানদের বিরুদ্ধে আলিবর্দী যখন যখন যুদ্ধযাত্রা করছেন, তখন দ্বারভাঙ্গা অঞ্চলে আফগানদের অত্যাচারে অতিষ্ট হিন্দু জমিদাররা আলিবর্দীকে সাহায্য করছেন। আবার অন্যদিকে মারাঠারা আফগানদের সহযোগিতা করছেন, কারণ আলিবর্দি তাদের শত্রু। অর্থাৎ হিন্দু-মুসলমান মানেই একে ওপরের বিরুদ্ধে লড়ছেন, হিন্দু ভূস্বামীরা মুসলমান শাসকদের সরিয়ে বাংলায় হিন্দুর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, বা মুসলমানরা হিন্দুকে কাফের জ্ঞানে কোতল করছেন -এই সময়ে অন্তত তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। তখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে স্বার্থ। যে স্বার্থ চরিতার্থ করতে গিয়ে আঞ্চলিক রাজারা, অভিজাতরা যাঁরা রাজনৈতিক ভাবে সিরাজের চেয়ে অনেক বেশি বিজ্ঞ তারাও ইংরেজদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার পরিণাম বুঝতে পারেননি। তবে সবকিছুরই তো ভালো খারাপ দু-ই তো আছে। -তাই এখান থেকেও একটা বিতর্কের সূত্রপাত হতে পারে। কেউ বলবেন, ‘ইংরেজরা না এলে আমরা মধ্যযুগের অন্ধকারে পড়ে থাকতাম’, কেউ বলবেন ‘ইংরেজরা সোনার বাংলা লুঠপাট করে আমাদের আগামী অনেক শতাব্দীর ভবিষ্যৎ তমসাময় করে দিল’। সেই আলোচনা অন্য একদিন হবে!
ঋণস্বীকার
সিয়ার-উল-মুতাক্ষেরিন - সৈয়দ গোলাম হোসেন তবাতবাঈ
মুর্শিদাবাদ কাহিনী – নিখিলনাথ রায়
সিরাজদৌল্লা – অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
বাঙ্গালার ইতিহাস - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
বাঙ্গালার ইতিহাস নবাবী আমল - কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়
The Indian Record Series : Bengal in 1756-1757 – S.C. Hill
Jahangir's India: The Remonstranite of Francisco Pelsaert - W.H. Moreland and P. Geyl
Travel Of A Hindoo – Bholanauth Chunder
হিস্ট্রি অফ বেঙ্গল - চার্লস স্টুয়ার্ট
Comments