top of page
Pink Paper
  • Writer's pictureAnirban Das

রসগোল্লার যুদ্ধ - রসগোল্লা বাংলার না উড়িষ্যার?

 

আজ আপনাদের শোনাবো একটা যুদ্ধের গল্প! ইতিহাসে ভূমি, সম্পদ এমনকি নারীকে কেন্দ্র করে নানা যুদ্ধ হয়েছে, রক্ত ঝরেছে; সেসব যুদ্ধের গল্প মর্মান্তিক, কটু-তিক্ত স্বাদের। তবে এই যুদ্ধের গল্পটা মিষ্টি! কারণ যুদ্ধটা যে বাঙালির নয়নের মণি রসগোল্লা নিয়ে! আমার ঘরের জিনিসকে আরেকজন যদি তারও ঘরের জিনিস মনে করে ব্যাপারটা কেমন দাঁড়ায় বলুন দেখি! বাংলা ওড়িষ্যার সেই দড়ি টানাটানিতে রক্ত ঝরেনি ঠিকই, তবে দু’পক্ষের আমলা আর গবেষকদের মাথার ঘাম কম ঝরেনি। দুজনের কাছেই এটা ছিল প্রেস্টিজ ফাইট! কেমন ছিল সেই যুদ্ধের বাতাবারণ, আপাত ভাবে সমঝোতা হলেও সত্যিই কি উত্তর পাওয়া গেল, রসগোল্লা তুমি কার? কী রসগোল্লার আসল ইতিহাস? -আজকের আলোচনা তারই চুলচেরা বিশ্লেষণ!


যুদ্ধের পটভূমি

বাংলার মিষ্টি জগৎবিখ্যাত। আর পৃথিবী বাংলার মিষ্টি বলতে একডাকে রসগোল্লাকে চেনে! বলতে গেলে রসগোল্লা বাঙালির কাছে একটা সাংস্কৃতিক পরিচয় বা তার কালচারাল আইডেন্টিটি! সবকিছু ঠিকই ছিল, কিন্তু ২০১৫ সালে ৩০ জুলাই উড়িষ্যা নিলাদ্রি বিজয়ার দিনে রসগোল্লা দিবস পালন করে বসলো! বাংলার প্রতিবেশী রাজ্য উড়িষ্যাতেও রসগোল্লা ভীষণ জনপ্রিয়, তাই মিষ্টি নিয়ে মাতামাতি তারা করতেই পারেন! কিন্তু আপাত নিরীহ এই উদযাপনেই ছিল যুদ্ধের বীজ। উড়িষ্যা আসলে রসগোল্লার জি-আই তকমা পেতে আবেদন করেছিল। তাই, ২০১৫ সালেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার তড়িঘড়ি রসগোল্লার জি-আই তকমার জন্য পালটা আবেদন করলো।


জি আই কী সেটা বলে রাখি, জি আইআসলে কোনো জিনিসের সত্ত্ব বা একটা ভৌগলিক মান্যতা বলা যেতে পারে। ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন এই মান্যতা প্রদান করে। যেমন দার্জিলিং চা, গোবিন্দভোগ চাল, ফজলি আম, শান্তিপুরের শাড়ি, বাংলার পটচিত্র -ইত্যাদি নানা বিষয়ের Geographical Indications ট্যাগ আমাদের দখলে আছে। তাতে সম্প্রতি যুক্ত হয়েছে টাঙ্গাইল শাড়ি, তা নিয়েও বাংলাদেশের সঙ্গে দড়ি টানাটানি শুরু হলো বলে! যাইহোক…


দু’বছরের সওয়াল-জবাব, প্রশ্ন-উত্তর-প্রমাণাদি দেওয়ার পর ২০১৭ সালের ১৪ নভেম্বর বাংলা পেল ‘বাংলার রসগোল্লার’ জি আই তকমা। প্রত্যাশিত প্রতিবাদ এলো উড়িষ্যা থেকেও। তারা এর প্রতিবাদে নানা প্রমাণ জোগাড় করে কতৃপক্ষের কাছে আবেদন করলেন এই মর্মে, “রসগোল্লা পশ্চিমবঙ্গের বাপের সম্পত্তি নয়, রসগোল্লা আমাদের!” এর মধ্যে বাংলা আর উড়িষ্যার গবেষকদের মধ্যে বাগযুদ্ধের মাত্রা চড়লো। অবশেষে ব্যাপারটাকে কর্তৃপক্ষ একটা সমঝোতার জায়গায় নিয়ে এলেন। রসগোল্লার একটা ‘ল’ কেটে তারা উড়িষ্যাকে দিলেন ‘রসগোলা’র জি আই ট্যাগ, আর বাংলার কাছে থাকলো বাংলার আস্ত রসগোল্লা! মীমাংসা তো হলো, কিন্তু সঠিক হলো কি?


রসগোল্লার ইতিহাস-বাঙালির কী মত?

ঠিক না ভুল সেটা বলতে গেলে রসগোল্লার ইতিহাসটা একটু দেখে নেওয়া দরকার। আমরা রসগোল্লার কলম্বাস বলে চিনি নবীনচন্দ্র দাশকে। তাঁর জন্ম ১৮৪৫-এ। আর তিনি রসগোল্লা আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৬৮ সালে, যখন তাঁর বয়স ২৩ বছর। তার আগে কি রসগোল্লার কোনো অস্তিত্ব ছিল না? কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের আগে যেমন আমেরিকা ছিল, এক্ষেত্রেও কতকটা সেকথা বলা যায়।


ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘লুচিতরকারী’ প্রবন্ধে রসগোল্লার আবিষ্কারক হিসেবে ফুলিয়ার হারাধন ময়রার নামোল্লেখ করছেন। রানাঘাটে তাঁর নামডাক ছিল। একবার মেয়ের কান্না থামাতে ফুটন্ত রসে একদলা ছানা ফেলে তিনি তৈরি করে ফেলেন সাদা গোলাকৃতি এক নরম পাকের মিষ্টি, যেটা আজকের রসগোল্লা পূর্বপুরুষ। তারপর হারাধন ময়রা এসে উঠেছিলন বাগবাজাবের কাছে কুমারটুলিতে। সেখানে দোকানও করেছিলেন। তাঁর দোকানেই শিক্ষানবিশ হিসাবে কাজে ঢুকে ছিলেন আধুনিক রসগোল্লার জনক এই নবীনচন্দ্র দাস। যাঁর হাতে রসগোল্লা বাঙালির আইকনিক স্পঞ্জ রসগোল্লায় রূপ পায়, খ্যাতি পায়। তাই নবীনচন্দ্র দাস ‘রসগোল্লার কলম্বাস’। কলকাতা জনপ্রিয় হবার আগেই নাকি বৈষ্ণবভূমি শান্তিপুরে রসগোল্লা তুমুল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। তাই রানাঘাট, শান্তিপুরের মধ্যে এখনও রসগোল্লা নিয়ে দড়ি টানাটানি চলে। তবে সে যাই চলুক, বাঙালির কাছে রসগোল্লার জন্ম এই বাংলায়, উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে। আর নবীনচন্দ্র দাশ তার রূপকার! কিন্তু এই বিষয়ে উড়িষ্যাবাসী কী বলছেন?


রসগোল্লার ইতিহাস-উড়িয়াদের কী মত?

বাংলার রসগোল্লার এই ইতিহাসকে এক ফুৎকারে উড়িয়ে দিচ্ছেন উড়িয়ারা! তাদের বক্তব্য মাত্র দেড়শ বছরের রসগোল্লার ইতিহাস নিয়ে বাঙালির হইচই ভিত্তিহীন! ওড্রভূমে রসগোল্লার ইতিহাস অনেক প্রাচীন। রথযাত্রার পর ফিরে এসে জগন্নাথ দেব দেবী লক্ষ্মীর মান ভাঙাতে খাইয়েছিলেন রসগোল্লা। সেই প্রথা মেনেই পুরীর মন্দিরে নীলাদ্রি বিজে বা বিজয়ার দিন রসগোল্লার ভোগ দেওয়া হয়। আর সেটা পুরীর মন্দিরের নথিবদ্ধ তথ্যে আছে! আগে বলছিলাম, ২০১৫ থেকে এই দিনটিই পালিত হচ্ছিল রসগোল্লা দিবস হিসেবে! শুধু পুরীর মন্দিরে রসগোল্লার ভোগ নয়, তারা বলছেন, উড়িষ্যার অন্যতম জনপ্রিয় কবি, পঞ্চকবির একজন বলরাম দাসের জগমোহন রামায়ণে রসগোল্লার উল্লেখ আছে। সেখানে অযোধ্যা কাণ্ডে রাম বনবাসে গেলে, তাঁকে ফিরিয়ে আনার জন্য ভরত ও শক্রঘ্ন যাত্রা করছেন, এবং পথিমধ্যে ভরদ্বাজের আশ্রমে আতিথ্য নিচ্ছেন। সেখানে তাদের সেবা করা হচ্ছে নানাবিধ খাবার, মিষ্টি ও রসগোলা দিয়ে। তাই ৫০০ বছর আগের সেই টেক্সটে গোটা গোটা করে লেখা আছে, “kora rasagola je amruta rasabali” (বোঝার সুবিধার্থে ইংরেজিতে লিখলাম)। এই বলরাম দাস চৈতন্যদেবের সমসাময়িক। অর্থাৎ এই কাব্য লেখা হয়েছে পঞ্চদশ শতকে! এরকম প্রমাণ ছড়িয়ে আছে ১৮৯২-এর ‘উৎকল দীপিকা’য়, ১৮৯৩-এর ‘বালি যাত্রা’য়, ১৯০৪-এর ‘উৎকল সাহিত্য’তে। তাহলে বাংলাতে রসগোল্লা কীভাবে এলো? -এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন, মহাপ্রভুর অনুগামীদের সূত্রে রসগোল্লা শান্তিপুরসংলগ্ন অঞ্চলে পৌঁছছে। যে কারণে শান্তিপুরের বৈষ্ণবভূমে রসগোল্লা জনপ্রিয়। আর কলকাতায় রসগোল্লা গেছে, উনিশ শতকে বাবুদের বাড়িতে উড়িয়া রাধুনিদের সূত্রে। তাই তাদের মতে মাত্র ১৫০ বছরের ঠুনকো ইতিহাস নিয়ে বাঙালির রসগোল্লার সত্ত্ব দাবি করা অন্যায়, অনুচিত!


উড়িয়াদের যুক্তি খণ্ডণ

রসগোল্লা যদি আপনার ইমোশন হয়, বা না-ও হয়, এহেন সওয়াল-জবাব শুনে বাঙালি হলে আপনি মুষড়ে পড়বেনই। দেখি ওদের যুক্তির পালটা আমরা কিছু দাঁড় করাতে পারি কিনা!

উড়িয়াদের কাছে আমাদের প্রথম প্রশ্ন, আমরা যতদূর জানি ছানা বা পনির শিল্প পোর্তুগিজদের দান। পোর্তুগিজরা এদেশে এসেছেন সপ্তদশ শতকে। তাহলে তার দু’শো বছর আগে, বা তারও বহু বহু বছর আগে ছানার রসগোল্লা বা রসগোলা এলো কোত্থেকে? আর ‘ছানা’ শব্দটাও যে বাংলা শব্দ? -এই প্রশ্নের উত্তরে তারা বলছেন, ‘বাজে কথা’! সংস্কৃতে ‘আমিকসা’, ‘দুধকুর্চিকা’ এই শব্দগুলোর উল্লেখ আছে ছানা অর্থেই। আর সেটা আছে চারশো খ্রিস্টাব্দের অমরকোষে। এবং ‘সংস্কৃত’ ছিন্ন থেকেই ছানা শব্দটা এসেছে। আর ছানার প্রচলন একটা পার্সিয়ান প্রভাব। তাই ছানা যদি পোর্তুগিজরা আসার আগে না-ই থাকবে, তবে ছানা নামটা কেন রয়েছে প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে?? বেশ, শুনলাম। এর উত্তরে আমরা বলতে পারি, প্রথমত ভারতীয় সংস্কৃতিতে ছানা প্রাচীনকাল থেকে কখনওই মান্যতা পায়নি। শ্রীকৃষ্ণের নানা কাহিনি আমরা সবাই কম বেশি জানি। সেখানে দুধ, দই, ঘি, সর, ননী, ক্ষীর -এই সবই তার প্রিয় খাদ্যতালিকায় ছিল, কিন্তু সেই তালিকায় কোথাও ছানা খুঁজে পেয়েছেন কি? পাবেন না। কারণ তখন বিশ্বাস করা হতো দুধ ফেটে ছানা হয়। আর দুধের মতো পবিত্র বিষয়ের এই বিকৃত রূপকে শুভকাজে বা দেবতার ভোগে উৎসর্গ করা যায় না। তাই বলে কি তখন ভূভারতে ‘ছানা’র অস্তিত্বই ছিল না? সেটা নয়। তখন কারোর ঘরে কি কখনও দুধ কাটতো না? নিশ্চই কাটতো, তাই তার একটা নাম তো থাকবেই। বিছুটি পাতা আমরা খাই না, বিছুটি গাছের কাছ ঘেঁষিনা বলে কি বিছুটির নাম নেই! আমাদের এতো প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্যে বাঙালির খাদ্যতালিকার সুবিস্তৃত বিবরণ রয়েছে, সেখানে রয়েছে হরেকরকম মিষ্টির কথাও। কিন্তু সেখানে কোথাও ছানা নেই। নেই কারণ সেভাবে তার প্রচলন ছিল না! তাই বলা যায়, দুধকে ইচ্ছাকৃত ফাটিয়ে ছানা বানানো হবে, সেই ছানা দিয়ে মিষ্টি বানানো হবে -এরকম ধারণাও আমাদের ছিল না। আর বাণিজ্যিকভাবে মিষ্টি তৈরি করতে গেলে কার ঘরে কখন দুধ ফাটবে, সেই অপেক্ষায় তো ময়রারা থাকবেন না, দুধ কাটাতে হবে। দুধকে অশুদ্ধি দিয়ে ছানা-কাটানোর ব্যাপারটাকে অশুভ হিসেবেই দেখা হতো, তাই সেটার চল ছিল না। একারণেই মানুষ ছানার সঙ্গে পরিচিত হলেও, আগে ছানার মিষ্টি হতো না।


অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে দুধ কাটিয়ে ছানা তৈরির চল আমাদের সংস্কৃতিতে কখনওই ছিল না। ক্ষীর, ননী, মাখন, দইয়ের নানারকম হতো। আর আজ বাঙালির পনির ও ছানার যে একটা বিরাট শিল্প, তার সূত্রপাত আধুনিকযুগে। এই প্রসঙ্গে ঢাকাই পনির বা ব্যান্ডেল চিজের কথা বলতে পারি। সেখানেও পোর্তুগিজদের একটা ভূমিকা আছে। -এবার অপরপক্ষ বলবেন, “তাহলে বলরাম দাসের লেখায় কীভাবে রসগোলা ও ছানা এলো পঞ্চদশ শতকে?” উত্তরটা দেবার আগে একটু দেখে নিই সেখানে কী লেখা আছে! ওড়িয়া শব্দ বাংলায় লিখলে সঠিক উচ্চারণে সমস্যা হতে পারে, তাই রোমানে লিখছি,- 'Hengu jera maricha naria dudha chhena,

Ghruta re kari nana pistaka rachana…

nari sarapuli je asira chhenapuli

kakara chhenaladu je malpua puri…

kora rasagola je amruta rasabali

manda nanamana amrutapani kadali”।

-মানে ভরতদের খেতে দেওয়া হচ্ছে হিং, জিরা, লঙ্কা, নারিকেল মিশ্রিত দুধের ছানা, ঘিয়ে ভাজা নানা পিঠে, ‘নাড়ি’ অর্থাৎ চালের আটার একধরনের পিঠে, সরপুলি, ‘আসিরা’ও চালের গুঁড়ো ও গুড় দিয়ে বানানো পিঠে আর ছানাপুলি, ‘কাকারা’ একধরনের পুরহীন মিষ্টি, ছানার লাড্ডু, মালপোয়া, পুরি। এছাড়া দেওয়া হচ্ছে কোরা, রসগোলা, মধুর মতো মিষ্টি রসবালি। -মধ্যযুগের খাব্যতালিকায় এরকম ভূরি ভূরি ছানার তৈরি খাদ্যসরঞ্জামের উল্লেখ কি আমাদের বাংলা সাহিত্যে কোথাও পাবেন? পাওয়া যাবে না। তাহলে উড়িয়া সাহিত্যে সেটা এলো কীভাবে? তার আগে একটা প্রশ্ন, এই জি আই পাওয়ার জন্য উড়িষ্যা সরকারের পক্ষ থেকে যে নথিপত্র প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, সেখানে প্রথমে রয়েছে পঞ্চদশ শতকের শেষার্ধে লেখা ‘দণ্ডী রামায়ণ’, ১৮৯২ -এর ‘উৎকল দীপিকা’, ১৮৯৩-এর ‘বালি যাত্রা’, ১৯০৪ -এর ‘উৎকল সাহিত্য’। এক্ষেত্রে আমার প্রথম প্রশ্ন ‘দণ্ডী রামায়ণ’-এর মূল পাণ্ডুলিপিটি কি পাওয়া গেছে? -না যায়নি। পঞ্চদশ শতক থেকে তালপাতার পুথিতে বিপুলভাবে উড়িয়া সাহিত্য রচিত হতে থাকে। ১৪৬৭ নাগাদ বলরাম দাস কাব্য লেখেন। কিন্তু তার ১০০ বছরের মাথায়, ১৫৬৮ তে কালাপাহাড় উড়িষ্যা আক্রমণ করে। তারপর ১৭৫১-তে মারাঠা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার আগে পর্যন্ত উড়িষ্যা ছিল মুসলমান শাসকদের অধীনে। সেই সময়টা উড়িষ্যার ইতিহাসে খুব একটা সুখের সময় নয়, ১৫৬৮ থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত তো নয়ই। সেই সময়ে বহু পাণ্ডুলিপি নষ্ট হয়। তবে বলরাম দাসের কাব্যটি এখানে আমাদের কৃত্তিবাসের কাব্যের মতো সবচেয়ে জনপ্রিয় কাব্য। তার প্রচুর প্রতিলিপি হয়েছিল। উড়িষ্যার তালপাতার পুথি সাহিত্য এরপর আবার মাথা তুলে দাঁড়ায় অষ্টাদশ শতকে। এখনকার বেশিরভাগ পুথিই সেই সময়কার। সবথেকে প্রাচীন যে পুথিটি উড়িষ্যায় সংরক্ষিত আছে, তা অভিনব গীতগোবিন্দ, প্রতিলিপি করা হয়েছিল ১৪৯৪ তে। এমনিতে ৩০০ বছরের বেশি তালপাতার পুথি টেকে না। তাই সেখান থেকে কপি করে রাখা হয়। আর রামায়ণের মতো এতো বিপুল জনপ্রিয় কাব্যে অনুলিপিকারদের হাতে, অন্য কোনো কবির দ্বারা কিছু অংশের সংযোজন-বিয়োজন ঘটবে -এ খুব স্বাভাবিক ঘটনা। আজ আমরা যে কাশীদাশী মহাভারত পড়ি, তার পুরোটা কি কাশীরাম লিখেছেন? না, তাঁর মৃত্যুর পরে অনেকটা অংশ সংযুক্ত হয়েছে।


আরেকটা বিষয় লক্ষ করুন, উড়িষ্যার পক্ষ থেকে যা প্রমাণ দেওয়া হয়েছে, সেখানে ১৪৬৭ সালের পর টপকে ১৮৯২-৯৩, ১৯০৪ সাল কেন? পঞ্চদশ শতকেরই আরও কাব্যের বা মাঝের সময়ের রেফারেন্স নেই কেন? কারণ নেই তাই। যে কারণে বাংলা সাহিত্যে নেই, সে কারণেই উড়িয়া সাহিত্যেও নেই। যেটুকু আছে, সেটা পরে সংযোজিত হয়েছে। সুতরাং প্রাচীনকাল থেকে উড়িষ্যায় রসগোলা তৈরি হয়ে আসছে এই দাবি সর্বৈব মিথ্যা। আর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে যে রসগোল্লা ভোগের কথা জানা যায়, ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’-এর মতো প্রাচীন গ্রন্থগুলির কোথাও কিন্তু জগন্নাথদেবের ভোগে রসগোল্লার উল্লেখ মেলে না। ক্ষীরমোহন বলে গোলাকার একটি মিষ্টির নাম পাওয়া যায়, যেটা আদতে রসগোল্লা নয়। জি আই-এর আবেদনেও এর কোনো প্রাচীন বা মধ্যযুগীয় ডকুমেন্ট তারা দেখাতে পারননি। সেখানে তার রেফারেন্স দিয়েছেন উড়িষ্যা গেজেটে প্রকাশিত ১৯৫৫ সালের একটি তথ্যের।


তাহলে উড়িষ্যার রসগোলা এলো কোত্থেকে? এটা কি কলকাতার দান? নাকি চৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে রসগোল্লা পাড়ি দিয়েছে উড়িষ্যায়? -এটার সপক্ষে দৃঢ় কোনো প্রমাণ আমি পাইনি। তবে পোর্তুগিজদের সঙ্গে বাংলার মতো উড়িষ্যার সম্পর্কও কিন্তু বহু পুরনো। বলা যায় চৈতন্যদেব ও পোর্তুগিজরা প্রায় একই সময়ে উড়িষ্যায় থাকতে শুরু করেন। সময়টা ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের শুরু। তখন থেকেই পোর্তুগিজরা পূর্ব ভারতে ঘাঁটি গাড়ার চেষ্টা করতে থাকে। এবং ১৫১৪ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তারা থিতু হয় উড়িষ্যার পিপলিতে। পিপলি বা পিপিলি এখন পুরী জেলার মধ্যে পড়ে। ১৫১৪ থেকে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দ -এই একশ বছর উড়িষ্যা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত ইউরোপীয়দের মধ্যে পোর্তুগিজদেরই একচেটিয়া আধিপত্য ছিল উড়িষ্যায়। তারপর ডাচরা তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখা দেয় ১৬২৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ। চৈতন্যদেব তাঁর জীবনের শেষার্ধ কাটিয়েছিলেন পুরীতেই। সেটা মোটামুটি ১৫০৯-১০ থেকে ১৫৩৩ খ্রিস্টাব্দ। আপনারা সকলেই জানেন এই দুই দশকের মধ্যে চৈতন্যদেব যেমন জগন্নাথ দেবের মূলতত্ত্বের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, ঠিক তেমনই সাংঘাতিকভাবে তিনি প্রভাবিত করেছিলেন পুরো নীলাচলকে। পুরীর সমসাময়িক রাজা তাঁকে মনে করতেন অবতাররূপ। বৈষ্ণব সমাজে ছানার মিষ্টিকে মান্যতা দিয়েছিলেন শ্রীচৈতন্যই। সেকারণেই শান্তিপুর-রানাঘাট রসগোল্লার প্রসূতি হিসবে দাবী জানায়। সেই ইতিহাস আগে বলেছি। এখন এটাই বলতে চাই, হতে পারে চৈতন্য-পার্ষদ ও অনুসারীদের সূত্রে ছানার বাড়বাড়ন্ত হয় পুরীতে। আবার এও হতে পারে পুরী জেলায় পিপলিতে পোর্তুগীজদের প্রভাবে ওই অঞ্চলের মানুষ ছানাকে ধীরে ধীরে গ্রহণ করেন, ঠিক যেমন বাংলার ক্ষেত্রে ঘটে। এবং চৈতন্যদেবের সূত্রে সেটা মান্যতা পায়, এবং তারপর রসগোল্লার জনপ্রিয়তা, লোকপ্রিয় দেবতা জগন্নাথ দেবের ভোগে তাকে স্থান দেয়! তবে বাঙালি ও উড়িয়াদের রসগোল্লা কিন্তু চরিত্রগতভাবে আলাদা। পিওর ছানা দিয়ে তা তৈরি হয় না, তাই সেটা হয় নরম। আর সেখানে ৬০-৪০ অনুপাতে চিনি জলের সিরাপকে প্রায় ১ ঘন্টা ধরে ক্যারামালাইজ করা হয়। ফলত উড়িষ্যার রসগোলা লালচে। 


তাই রসগোল্লার একমাত্র অরিজিন হিসাবে উড়িষ্যার এই যে দাবি, তা ভিত্তিহীন। তাঁদের নিজেদের মতো করে একটা ইতিহাস আছে, সেটা নিয়েই তারা খুশি থাকলে এই যুদ্ধ বা আজকের তর্কযুদ্ধের প্রয়োজন পড়তো না! তবে হয়েও মন্দ হলো না কী বলেন? ঝুলে থাকার থেকে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া তো ভালো! আর এই সওয়াল-জবাবে উকিল হিসেবে আমি কত নম্বর পেতে পারি বলুন তো? 


তথ্যসূত্র

 

 


The Battle Of Rasagola Vs Rosogolla, History of Rasagulla

Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
bottom of page