জগন্নাথ দেব ভগবান বিষ্ণুরই এক রূপ! -কিন্তু যদি বলি, সে অনেক পরের কথা। আর অনেক আগে থেকেই তাঁকে আমরা খুঁজে পাবো ভারতের প্রাচীন অরণ্যচারী আদিবাসী মানুষদের আরাধ্য দেবতা হিসেবে? সে-অর্থে তিনি আদিবাসীদেরই নিজস্ব দেবতা? অবাক হবেন? জগন্নাথ দেবের এই ইতিহাস শুধুমাত্র হিন্দু ধর্মের একটি রূপান্তরিত দেবতার কাহিনি নয়; বরং এটি আদিবাসী উপাসনা থেকে বৈদিক আচার; বৌদ্ধ ও জৈন প্রভাব এবং তান্ত্রিক সাধনার এক অনন্য মেলবন্ধনের প্রতিফলন। এই প্রবন্ধে, আমরা জগন্নাথ দেবের সেই উৎসমুখটিতেই যাওয়ার চেষ্টা করবো।
জগন্নাথ দেব সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনি
জগন্নাথ দেবের উৎপত্তি নিয়ে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনিগুলি বেশিরভাগই স্কন্দ পুরাণ, ব্রহ্ম পুরাণ, এবং সরলা দাসের উড়িয়া মহাভারত থেকে উদ্ভূত। এই কাহিনিগুলো থেকে মূলত যেটা জানা যায় যে, শবর সমাজের উপাস্য নীলমাধবের সঙ্গে ভগবান বিষ্ণুর রূপসমন্বয়েই জগন্নাথ দেবের আবির্ভাব। স্কন্দ পুরাণের উৎকল খণ্ডে এই বিষয়ে একটা কাহিনি রয়েছে। এই কাহিনিটা কত পুরনো, সেটা বোঝা যেতে পারে স্কন্দ পুরাণের বয়স আন্দাজ করে। স্কন্দ পুরাণ, সব পুরাণের মধ্যে বৃহত্তম শুধু নয়, অন্যতম প্রাচীন। আজ থেকে কমপক্ষে বারোশো থেকে দেড় হাজার বছর আগে লেখা হয়েছিল স্কন্দ পুরাণ। সেখানকার ‘উৎকল খণ্ডে’ রয়েছে, অবন্তীর বিষ্ণুভক্ত রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন তাঁদের কুলপুরোহিতের ভাই বিদ্যাপতিকে ওড্রদেশে পাঠিয়েছিলেন সেখানে কোথায় নীলমাধবের পুজো হয়, তার সন্ধান আনার জন্য। এই অবন্তী আজকের মধ্যপ্রদেশ। যাইহোক, বিদ্যাপতি ওড্রদেশ অর্থাৎ আজকের উড়িষ্যায় আসেন, এবং এখানে এসে নীলশৈল নামে এক পাহাড়ের কাছে শবরদের গ্রামে আশ্রয় নেন। সেই শবরদের নেতা ছিলেন বিশ্ববসু, বিদ্যাপতির তাঁর আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন, এবং বিশ্ববসুর মেয়ে ললিতাকে তিনি বিয়ে করেন। এই শবররা ছিলেন নীলমাধবের উপাসক। বিশ্ববসুর বিশ্বাস অর্জন করে বিদ্যাপতি নীলমাধবের সেই গোপন পুজোস্থানের খোঁজ পান। যার খোঁজেই তাঁকে এখানে পাঠিয়েছিলেন ইন্দ্রদ্যুম্ন। তাই সেই সংবাদ তিনি ফিরে গিয়ে জানান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নকে। উৎফুল্ল ইন্দ্রদ্যুম্ন নারদের সঙ্গে উড়িষ্যার অভিমুখে যাত্রা করেন, কিন্তু উড়িষ্যার সীমানায় পৌঁছতেই তাঁরা খবর পান যে নীলমাধব অন্তর্হিত হয়েছেন, মানে ভ্যানিশ হয়ে গেছেন! এই খবরে স্বাভাবিকভাবেই ইন্দ্রদ্যুম্ন ভেঙে পড়লে, নারদ তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, ভগবান দারু রূপে আবার আবির্ভূত হবেন। তারপর একদিন সমুদ্রে এক বিরাট কাঠের খণ্ড ভেসে আসে, রাজা মহোৎসাহে তা তুলে এনে মহাবেদীতে স্থাপন করেন, এবং নীলমাধবের স্বপ্নাদেশ পাবার পর ওই কাষ্ঠখণ্ড থেকে মূর্তি নির্মাণে উদ্যোগী হন। কিন্তু কাঠ থেকে মূর্তি নির্মাণের জন্য কাউকে পাওয়া যায় না, এমন সময় এক বুড়ো ছুতোরের ছদ্মবেশে আসেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। তিনি শর্ত দেন, ২১ দিন ধরে তিনি মূর্তি নির্মাণ করবেন, কিন্তু কেউ তা দেখতে পারবে না। সেই শর্ত মতো কাজ এগোতে থাকে। আর রাজা ও রানী, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেন। কান পেতে ঠুকঠাক আওয়াজ শোনেন, আর দিন গোনেন। কিন্তু কিছুদিন পর আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। রানী গুণ্ডিচা তখন আর নিজেকে সামলাতে পারেন না, উৎকণ্ঠায়-আগ্রহে দরজা খুলে ফেলেন। জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার মূর্তি অসমাপ্ত রেখেই অন্তর্হিত হন সেই বৃদ্ধ শিল্পী। তখন ওই ভাবেই বিগ্রহদের পুজো করার দৈবাদেশ পান রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। আজও সেই রূপেই জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রার ত্রিমূর্তি পূজিত হয়ে আসছে।
স্কন্দ পুরাণ ছেড়ে আমরা যদি ব্রহ্ম পুরাণ বা সরলা দাসের উড়িয়া মহাভারত দেখি, সেখানেও কিন্তু এই গল্পই আসছে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মোটের ওপর যার মূল কাঠামোটা মোটামুটি একই। সরলা মহাভারত আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে লেখা, আর ব্রহ্ম পুরাণের বয়স সাতশো বছর, কারণ সেখানে ত্রয়োদশ শতকে নির্মিত কোনারকের সূর্য মন্দিরের কথা আছে। সে হিসাবে বলা চলে এই ব্রহ্ম পুরাণ ত্রয়োদশ শতকের পরেই লেখা হয়েছে। আর স্কন্দ পুরাণের বয়স বললাম ঠিকই দেড় হাজার বছর মতো, কিন্তু দ্বাদশ শতক পর্যন্ত স্কন্দ পুরাণে নানা সংযোজন হয়েছে। তাই ইন্দ্রদ্যুম্নের কাহিনি প্রথম থেকেই সেখানে ছিল, না পরের সংযোজিত হয়েছে, তা নিয়ে একটা প্রশ্ন আছেই। তবে একথাও তো ঠিক যে সমাজের একেবারে নিচের তলাতেও যেমন মাতৃশক্তির পুজো হয়, তেমনই উচ্চবর্ণের মধ্যেও হয়! তাহলে জগন্নাথের ক্ষেত্রে এভাবে দাগিয়ে দেওয়ার ভিত্তি কী যে জগন্নাথ আদিবাসীদেরই দেবতা। এখান থেকেই আমাদের আলোচনাটা ইতিহাসভিত্তিক।
শবর সমাজের দেবতা কিটুং থেকে নীলমাধব
আগের পৌরাণিক কাহিনিগুলোতে নীলমাধবের উল্লেখ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নীলমাধব নামে দেবতার যে রূপ সেখানে আমরা পাই, তা আদিম শবর সমাজের উপাসনা এবং আর্য সমাজের বৈদিক প্রভাবের এক যোগফল। এখন প্রশ্ন শবর কারা? আমাদের পূর্বভারতের যে জনগোষ্ঠীর প্রভাব আমাদের উপর সবচেয়ে বেশি, তারা প্রোটো-অস্ট্রালয়েড বা আদি-অস্ত্রাল। সেই আদিম জনগোষ্ঠীর চিহ্নই বহন করছে মুণ্ডাভাষী শবররা। বিন্ধ্য পর্বত, মহেন্দ্র পর্বত অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকেই বৃক্ষ উপাসক শবরদের বসবাস ছিল। রামায়ণে, মহাভারতে বিভিন্ন প্রসঙ্গে বারবার এদের কথা উঠে এসেছে এসেছে। এরা শাখাপ্রশাখাহীন এক প্রাচীন বৃক্ষকাণ্ডকে পুজো করতো, ঠিক যেমনটা আমাদের চড়ক গাছ। তাকে বলা হতো স্থানুমূর্তি। এছাড়া শবররা পুজো করতো ‘কিটুং’ নামে এক দেবতার। হতে পারে কিটুং তাদের কোনো প্রাচীন পূর্বপুরুষ, মিথ হয়ে যাওয়া কোনো বীর! আমাদের একএকজন দেবতারই যেমন অনেক আলাদা আলাদা নাম হয়, তেমনই এই কিটুং-এরও নানা নাম। তারমধ্যে রয়েছে জগন্ত, জগবই, জগনায়েলো -এই নামগুলো।
একটু আগেই বললাম, রামায়ণ, মহাভারতে বারবার শবরদের উল্লেখ পাওয়া যাচ্ছে। রামায়ণে রামের যাত্রাপথে দণ্ডকারণ্য, মহাভারতে ভীম-সহদেবের পূর্বভারতে যাতায়াত -ইত্যাদি নিয়ে সংস্কৃত সাহিত্যে নানা কাহিনি গড়ে উঠেছে। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যুও কিন্তু হয়েছিল এক শবরেরই তীরে! -এসব থেকে এটাই প্রমাণিত হয়, যে ধীরে ধীরে পূর্বভারতে বঙ্গের মতো কলিঙ্গ প্রদেশেও বা ওড্রদেশেও উত্তরাপথের আর্যসভ্যতার প্রভাব পড়ছিল। ভাগবতের একটা শ্লোক লক্ষ করুন, যেখানে বলা হচ্ছে, “কিরাতহূণান্ধ্রপুলিন্দপুল্কশা। / আভীরকঙ্কা যবনাঃ খসাদযঃ। / যেহন্যে চ পাপা যদপাশ্রযাশ্রযাঃ। / শুধ্যন্তি তস্মৈ প্রভবিষ্ণবে নমঃ।।” অর্থাৎ কিরাত, হুন, অন্ধ্র, পুলিন্দ, পুল্কশাদি জাতিরা যারা নিচ, পাপাচারী তারা যদি ভগবানের স্মরণে আসে, ভগবানের কৃপায় তারাও শুদ্ধ হয়ে যায়। এবং এখানে পূর্ব ভারতের অনেকগুলো আদিম জাতিগোষ্ঠীর নাম আসছে, যাদের বিষ্ণুর স্মরণ নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, এটাকে আমরা এদিককার নিম্নেতর জাতির মধ্যে আর্যীকরণ ও বিষ্ণু উপাসনার সম্প্রসারণের একটা চিহ্ন হিসেবে দেখতে পারি।
পুরাণ ছেড়ে যদি ইতিহাসের দিকে দেখি, ১১১৯ খ্রিস্টাব্দে অনন্তবর্মণ চোদাগঙ্গার তাম্রলিপিতে রয়েছে, যে খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে গঙ্গা সাম্রাজ্যের সূচনা হয়েছিল যাঁর হাতে, সেই কামার্ণব মহেন্দ্রগিরি পর্বত সংলগ্ন অঞ্চলে আসেন এবং শবর রাজা বলাদিত্যকে পরাস্ত করে, ওই অঞ্চল নিজের অধিকারভুক্ত করেন। সেই সময়ে শবররা শিবের উপাসক ছিল, আজও মহেন্দ্রগিরিতে সেই সময়ের ইতিহাসের সাক্ষী নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে কুন্তী শিবের মন্দির। আদি মন্দিরটি সপ্তম শতাব্দীরও প্রাচীন। এবং সেখানে মূর্তি নয়, লিঙ্গ পূজিত হতো। আর অনন্তবর্মণদেবের কথা মতো কামার্ণবও সেই দেবতারই স্মরণ নেন। এটাও কিন্তু শবরদেবতার আর্যীকরণের একটা সূত্র।
নীলমাধব থেকে জগন্নাথ
ইন্দ্রদ্যুম্নের কাহিনিতে জগন্নাথ দেবের আদিরূপ হল নীলমাধব। যেখানে দুটো শব্দ জুড়ে আছে, ‘নীল’ ও ‘মাধব’। মাধব কৃষ্ণের অন্যনাম। সুতরাং তিনি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের আদি-অকৃত্রিম দেবতা হতে পারেন না। অন্যদিকে ‘নীল’ শব্দটার দিকে যদি লক্ষ করেন, উড়িষ্যায় বহু সূত্র আপনি পাবেন। পুরীর ক্ষেত্রকে নীলাচল বলা হয়, শবরদের আদি বাসস্থান নীলগিরি পর্বত, স্কন্দ পুরাণে আমরা নীলশৈল নামটা পাচ্ছি। এবং এও জানা যাচ্ছে শবররা কোনো এক নীল শিলার পুজো করতো, যা বিদ্যাপতি দেখেছিলেন। আবার এই যে শিবের প্রসঙ্গটা উড়ে এসে জুড়ে বসলো; নীল পুজোয়, যাকে আমরা নীলষষ্ঠী বলে জানি, সেখানে কিন্তু শিবকেই পুজো করা হয়। এই বৃক্ষ-উপাসক শবর সম্প্রদায়ের কোনো প্রাচীন দেবতা এই নীল, তার রূপ কী ছিল, তা আমরা জানি না, কিন্তু সারা ভারতে প্রাচীনতম সভ্যতার উপাসনার ধারায় ‘নীল’ ছিল, সে কারণেই নীল তারা, নীল সরস্বতী ইত্যাদি নানা ভাবে তাঁকে আমরা পরবর্তীকালে পেয়েছি। আর এই শবররা যখন ধীরে ধীরে আর্যপ্রভাবে বিষ্ণু উপাসনা শুরু করলো, সেটা সম্ভববত বঙ্গের মতোই সেটা গুপ্তযুগ বা তার পরবর্তী সময় থেকে, তখন নীলের সঙ্গে যুক্ত হলেন মাধব। শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু নিয়ে পৌরাণিক গল্পটা আমাদের জানা, যে এক শবরের তীরে শ্রীকৃষ্ণের মৃত্যু হয়। মৃত্যুর পর তাঁর দেহ সৎকারের ব্যবস্থা করা হলে বেশ কিছু দিন যাবৎ পোড়ার পরও শ্রীকৃষ্ণের দেহের একটা অংশ অদগ্ধ অবস্থায় থাকে। যা ভাসিয়ে দেওয়া হয় সাগরে। সেটাই ভাসতে ভাসতে আসে ওড্রদেশে, কোনো শবর সেটা পান, শবররা নীলমাধব রূপে তার উপাসনা শুরু করেন। কথিত আছে, কৃষ্ণের সেই দেহাবশেষই জগন্নাথ দেবের মূর্তির ব্রহ্মবস্তু! বলাবাহুল্য পৌরাণিক এই কাহিনির মধ্যেও রয়েছে শবরদের আর্যীকরণের সংকেত! আর নীলমাধব থেকে এই যে জগন্নাথ, এই ‘জগন্নাথ’ নামটির আদি উৎসও শবরদের সেই উপাস্য ‘কিটুং’ এর অপর নাম ‘জগন্ত’এর মধ্যে নিহিত।
জগন্নাথের রূপ ও পুজো-আচারে আদিবাসী সংস্কৃতির প্রাধ্যান্য
শুধু নামে নয়, রূপে এবং পুজো-আচারের দিক থেকেও জগন্নাথ মন্দিরে লক্ষ করা যায় আদিবাসী প্রভাব। আদি-অস্ত্রালদের মধ্যে এই ধরনের ফিগার বা দেহপ্রতিকৃতির ধারণা আছে। সেটা এদেশে যেমন দেখা যায়, আজ থেকে ২৫-৩০ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার গুহাচিত্রেও তার দেখা মেলে। আর তা দেখতে হুবহু আমাদের জগন্নাথদেবের মতোন। জগন্নাথের মূর্তির একটা সূত্র মেলে আদিবাসী লোকসমাজে কিটুং-এর এক প্রচলিত গল্পে। যে একবার পাথর ভাঙতে গিয়ে কিটুং মারাত্মকভাবে আহত হন। তাঁর দুই পা-ই নষ্ট হয়ে যায়, মাথায় ও গায়ে আঘাত লাগে। মরণাপন্ন কিটুং তাঁর ওইরকম বিকলাঙ্গ মূর্তিই তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে পুজো করতে বলেন। সেভাবেই গড়ে ওঠে কিটুং-এর মূর্তি। এটা কাহিনি হতে পারে, কিন্তু প্রিমিটিভ কালচারে মূর্তি-প্রতীকের রূপ এরকমই ছিল। তাই নীলমাধব সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুর রূপের সঙ্গে মিশে গেলেও, জগন্নাথ রয়ে যান আদি-অকৃত্রিম। কারণ যা মূর্তিহীন, সেটা যত সহজে ধারণায়, বা মূর্ত রূপে বদলাতে পারে; তার থেকে বহুল প্রচলিত, বহু মানুষের বিশ্বাসের আধার কোনো মূর্তিকে বদলানো অনেক বেশি কঠিন।
তবে শুধু রূপ নয়, পুরীর মন্দিরে সব গুরুত্বপূর্ণ আচারই হয় আদিবাসী সমাজের নানা ধর্মবিশ্বাস মেনে। আর তার দায়িত্বে থাকেন দৈতাপতিরা, যাঁরা শবর রাজা বিশ্ববসুর উত্তরসূরী। কোনোদিনও শুনেছেন কোনো মন্দিরে ভগবানকে মাটি খুঁড়ে সমাধি দিয়ে তারপর ভক্তরা অশৌচ পালন করে? জগন্নাথদেবের যখন নব কলেবর হয়, তখন তাঁর পুরনো দারু মূর্তিটি মাটিতে সমাধিস্থ করা হয়। ঠিক যেমন আদিবাসী সমাজে কেউ মারা গেলে করা হতো। তারপর দশদিন দৈতাপতিরা অশৌচ পালন করে, নখ কেটে, ক্ষৌরকর্ম করে অশৌচ ভাঙেন। কারণ জগন্নাথ যে তাদের কিটুং-এরই এক রূপ, তাদেরই একজন।
নবকলেবরে বিগ্রহের মধ্যে ব্রহ্মবস্তু স্থাপন থেকে, নতুন মূর্তি নির্মাণের কাঠ খুঁজে আনা, সবই করেন শবর সমাজের প্রতিনিধি দৈতাপতিরা। পুরী থেকে কিছু দূরে কাকটপুরে মঙ্গলাদেবীর মন্দিরের কাছ থেকে দৈতাপতিরা নতুন বিগ্রহগুলির কাঠের জন্য নতুন গাছের সন্ধানে বেরোন। যে গাছগুলিতে কোনও পাখির বাসা নেই, মূলে বিষধর সাপের আস্তানা আছে। যে গাছে রয়েছে তিন, পাঁচ বা সাতটি করে ডাল, আর বিশেষ কিছু চিহ্ন, সেই গাছের কাছে বলি দিয়ে, দৈতাপতিরাই তাকে কেটে নিয়ে আসেন। মানা হয় নানা নিয়ম। যেগুলো ব্রাহ্মণ বা বৈদিক নিয়মাচার নয়। আবার রথের সময়েও রথের কাপড় থেকে রথের রশি, সবতেই প্রথম অধিকার এই দৈতাপতিদের। সেখানে ভগবান আদিবাসী সমাজের নিয়মানুযায়ী ঈশান কোণ বরাবর যাত্রা করেন, আর্য-সংস্কৃতি অনুযায়ী পূর্ব অভিমুখে নয়। আর যখন জগন্নাথ অসুস্থ হন, তখনও তার সেবা করেন ব্রাহ্মণ পুরোহিত নন, দৈতাপতিরাই। পুরীর মন্দিরে নিচজাতির হাতেই সম্পন্ন হয় ভগবানের স্নান, কাপড় পরা, খাওয়া-দাওয়া -ইত্যাদি একান্ত সেবাকর্মের নানা ভার।
তা বলে এটা নয় যে পুরীর মন্দিরে ব্রাহ্মণ ব্রাত্য। বরং এই ভারতের বৈচিত্র্যময় ধর্ম-উপাসনার ধারার এক মহামিলন লক্ষ করা যায় পুরীর জগন্নাথ দেবের মন্দিরে। তাই যেখানে বিষ্ণুর অধিষ্ঠান, যেখানে পুজো হয় বৈষ্ণব মতে, সেখানেই শক্তি উপাসনার সতীপীঠ। শাক্ত মতে মন্দির প্রাঙ্গণে পশু বলিও হয়। আবার যে মন্দির হিন্দুদের প্রধান চার ধামের একটি, এতো বিপুল তার মাহাত্ম্য, অথচ, আমাদের সমাজের একেবারে নিচের তলার মানুষ, উচ্চবর্ণের সমাজ একদিন যাদের ছায়া মাড়াতো না, ছোঁয়া খেত না, দেবতা এখানে তাঁদের কাছেই স্নান করেন, কাপড় পরেন, তাঁদের হাতেই খান! তাঁরা যে শুধু ভক্ত নন, দেবতার পরময়াত্মীয়! বিবেকানন্দ মন্তব্য করেছিলেন জগন্নাথ দেব বৌদ্ধ দেবতা। শুধু বৌদ্ধ নয়, বৌদ্ধ, জৈন, তান্ত্রিক -ইত্যাদি নানা ধারা এসে মিশে যায় জগন্নাথ দেবের মধ্যে। শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব, আর্য-অনার্য, ব্রাহ্মণ-শূদ্র, -এই ইতিহাসে কেউ অপাংক্তেয় নন, ব্রাত্যজন নন। সবাইকে নিয়েই এই সভ্যতার রথ চলে! এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরে এটাই ভারতাত্মা, ভারতের সনাতন ধর্মের বিন্দুরূপ! আর তাই জগন্নাথ দেবের শিকড় আদিম ভারতীয় জনজীবনের অনেক গভীরে প্রোথিত। আজ শুধু তার আদিমতম দিকটাই দেখা হলো, কোথায় বৌদ্ধ, কোথায় জৈন, কোথায় শাক্ত, কোথায় তন্ত্র -সেগুলো সম্পূর্ণ আলাদা আলাদা গল্প! সেই আলোচনা আগামীর জন্য তোলা থাক!
ঋণস্বীকার
The history of Orissa - Dr.H.K.Mehtab
Srimad Bhagavatam – SB 2.4.18
![আদিবাসী দেবতা জগন্নাথ](https://static.wixstatic.com/media/b48949_5b24a9c6b4684e5181738c6ece070da0~mv2.webp/v1/fill/w_980,h_560,al_c,q_85,usm_0.66_1.00_0.01,enc_auto/b48949_5b24a9c6b4684e5181738c6ece070da0~mv2.webp)
Comments