top of page
Pink Paper
  • Writer's pictureAnirban Das

বাংলার হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস: তাম্রলিপ্তির গৌরবময় অতীত

ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের কথা উঠলেই আমরা সাধারণত হরপ্পা-সিন্ধু সভ্যতার কথা বলি, যা ছিল সেই সময়ের তুলনায় উন্নত এবং আধুনিক। এই সভ্যতা নিয়ে আমাদের গর্ব করার যথেষ্ট কারণও আছে। তবে, একটা বিষয় আমরা প্রায়শই ভুলে যাই—হরপ্পা-সিন্ধু সভ্যতা বা পরবর্তীকালের আর্যাবর্তের সভ্যতা, কোনোটাই বাংলার মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। বাংলার মাটিতে কি তাহলে আমরা প্রাচীন কোনো সভ্যতার ইতিহাস খুঁজে পাই না? পাই, তবে তা নিয়ে আলোচনা কম হয়, আর জানানো হয় আরও কম। তাই আজকের এই লেখায় বাংলার হারিয়ে যাওয়া এক সুপ্রাচীন নগরের গল্প বলব, যা আড়াই-তিন হাজার বছর আগে শুধু ভারতের নয়, সারা বিশ্বের বাণিজ্য মানচিত্রে সুপরিচিত ছিল। বলছি তাম্রলিপ্তির কথা—একটি বিস্মৃতপ্রায়, কিন্তু গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের নাম।


তাম্রলিপ্তি: বাংলার হারিয়ে যাওয়া রত্ন

তাম্রলিপ্তির নাম হয়তো আমাদের কাছে নতুন নয়, তবে এর পেছনের গল্পটি অনেকের কাছেই না-শোনা। বর্তমান মেদিনীপুর জেলার তমলুক শহরের আড়ালে লুকিয়ে আছে প্রাচীন তাম্রলিপ্তির অস্তিত্ব। কিন্তু তমলুককে প্রাচীন তাম্রলিপ্তির রূপে দেখার ভুল করবেন না। যদিও তাম্রলিপ্তির পুরো গল্প জানতে হলে আমাদেরকে প্রাচীনকালে ফিরে যেতে হবে।

প্রাচীন বাংলার এই তাম্রলিপ্তি ছিল পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত বন্দর। এই বন্দর থেকেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, আরব, আফ্রিকা, এমনকি গ্রিস এবং রোমের সাথে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। তাম্রলিপ্তির বাণিজ্যিক গুরুত্বের পিছনে তার ভৌগলিক অবস্থানের বিশেষ ভূমিকা ছিল। এটি ছিল গঙ্গা ও ভাগীরথী নদীর মোহনায়, যা সহজেই বঙ্গোপসাগরে মিশেছে। এই সহজ নদীপথে ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চল থেকে পণ্য নিয়ে আসা হতো এবং সেখান থেকে তা সমুদ্রপথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো।


প্রাচীনকালের তাম্রলিপ্তি

তাম্রলিপ্তির প্রাচীনত্ব বোঝার জন্য আমাদেরকে প্রায় ২৩০০ বছর পূর্বে মৌর্য সাম্রাজ্যের সময়ে ফিরে যেতে হবে। এটাই ছিল সেই সময় যখন বঙ্গদেশের রাজনৈতিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। তবে তার আগেও তাম্রলিপ্তি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ নগরী, যার বাণিজ্যিক ও সামাজিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

বৈদিক সাহিত্য বাংলার সভ্যতা নিয়ে প্রায় সম্পূর্ণ নীরব, যদিও মহাভারত এবং বিভিন্ন পুরাণে তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। মহাভারতে ভীমের দিগ্বিজয়ের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ভীম মুদ্দগিরি, পুণ্ড্র, বঙ্গ এবং তাম্রলিপ্তির রাজাদের পরাজিত করেন। এছাড়াও, বিষ্ণু পুরাণ, মত্স্যপুরাণসহ বিভিন্ন পুরাণে তাম্রলিপ্তির নাম বারবার উঠে আসে।

তাম্রলিপ্তি ছিল শুধু একটি বন্দর নগরী নয়, এটি ছিল একটি সমৃদ্ধশালী শহর, যা রাজনৈতিক, সামাজিক এবং বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। জৈন ‘কল্পসূত্র’, বৌদ্ধ ‘মহাবংশ’ এবং ‘জাতক’ গ্রন্থগুলোতে তাম্রলিপ্তির উল্লেখ রয়েছে, যা এর প্রাচীনত্বের পক্ষে শক্তিশালী প্রমাণ। এছাড়াও, কৌটিল্যের ‘অর্থশাস্ত্র’, সোমদেবের ‘কথাসরিত্সাগর’, এবং বরাহমিহিরের ‘বৃহত্সংহিতা’ গ্রন্থেও তাম্রলিপ্তির কথা বলা হয়েছে।


তাম্রলিপ্তির গুরুত্ব ও পতন

তাম্রলিপ্তির গৌরবোজ্জ্বল সময় অবশ্য চিরস্থায়ী ছিল না। সপ্তম শতাব্দীর শেষের দিকে এটি ম্লান হতে শুরু করে। এর পিছনে একটি বড় কারণ ছিল ভাগীরথী ও সরস্বতী নদীর গতিপথ পরিবর্তন। নদীর এই পরিবর্তন তাম্রলিপ্তির বাণিজ্যিক গুরুত্বকে প্রভাবিত করে, এবং একসময় সমুদ্রতীরবর্তী এই শহরটি সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর ফলে তাম্রলিপ্তির স্থান দখল করে নতুন বন্দর সপ্তগ্রাম।

তাম্রলিপ্তির বাণিজ্যিক পতন হলেও এর সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব কখনও ম্লান হয়নি। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে এখান থেকে পাওয়া বিভিন্ন নিদর্শন আমাদের সেই সোনালী অতীতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এই খনন কাজগুলি থেকে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলি তাম্রলিপ্তির প্রাচীন গৌরবের প্রমাণ বহন করে।


তাম্রলিপ্তির ইতিহাস আমাদের এক সোনার অতীতের কথা বলে, যা আজকের বাংলার পরিচিতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তাম্রলিপ্তি আমাদের হারিয়ে যাওয়া এক সভ্যতার গল্প শোনায়, যা শুধু বাণিজ্যিক কেন্দ্রই নয়, বরং একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও সামাজিক কেন্দ্র ছিল। আমাদের এই গৌরবময় অতীতকে সংরক্ষণ করা এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দেওয়া আমাদের দায়িত্ব।

এই গল্প যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে, তবে তা শেয়ার করুন এবং বাংলার এই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের গল্পগুলি আরও মানুষের কাছে পৌঁছতে সাহায্য করুন। আপনি যদি তাম্রলিপ্তি বা বাংলার প্রাচীন নগরীগুলোর বিষয়ে আরও কোনো তথ্য জানেন, তবে কমেন্ট করে আমাদের সাথে শেয়ার করুন। এই ঐতিহাসিক যাত্রায় আমার সাথে থাকার জন্য ধন্যবাদ।


তথ্যসূত্র:

  1. বাঙালির ইতিহাস: নীহাররঞ্জন রায়

  2. The Archaeology of Coastal Bengal: Rupendra Kumar Chattopadhyay

  3. Rivers of the Ganga-Brahmaputra-Meghna Delta: A Fluvial Account of Bengal: Kalyan Rudra

  4. “Tamralipti: The Ancient port of India”: ‘Studies in History and Culture’ – S. Tripathi & S.R. Rao

  5. https://www.peepultree.world/livehistoryindia/story/lost-cities/tamralipti-the-ancient-copper-port

  6. https://bonikbarta.net/print-magazine/4135

 

তাম্রলিপ্ত- প্রাচীন বাংলার গুরুত্বপূর্ণ বন্দর

Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
bottom of page