top of page
Pink Paper
  • Writer's pictureAnirban Das

প্রাচীনকালে বাঙালির ব্যাবসার ইতিহাস

Updated: Sep 6


‘বাঙালি ব্যাবসা বিমুখ’ – এই কথাটার সঙ্গে আপনি কি সহমত? আজ যদি বাঙালিকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি নিজে কী করতে চান, চাকরি না ব্যাবসা? বা কোনো বাবা-মাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনার সন্তানকে ভবিষ্যতে কোন পেশায় প্রতিষ্ঠিত দেখতে চান, সিংহভাগ মানুষই কিন্তু বলবেন কোনো না কোনো ‘চাকরি’। সেকারণেই হয়তো তৈরি হয়েছে এরকম ন্যারেটিভ যে ‘বাঙালি ব্যাবসা বিমুখ’। এর পিছনে একটা কারণও রয়েছে বাঙালির অর্থনৈতিক দুর্বলতা। তাই ‘কেন ব্যাবসা করতে চান না?’ -এই প্রশ্নের উত্তরে বেশিরভাগ আজ বলবেন, ‘পুঁজির অভাব’। কিন্তু আমার মনে হয়, ব্যাবসা করতে পুঁজি নয়, উদ্যম আর বুদ্ধি লাগে। যাতে আজ নিঃসন্দেহে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির দৈন্য আছে। কিন্তু ব্যাবসা বুদ্ধিতে বাঙালি কি বরাবরই পিছিয়ে? আমাদের অতীত কিন্তু সেকথা বলে না। প্রাচীনকালে শুধু দেশে নয়, বাঙালি ব্যবসা করতে পাড়ি দিত বিদেশেও। এবং সেকালের গৌরবগাথা যা আজও কান পাতলেই শোনা যায়, কান পাততে হবে, তা কিন্তু মূলত এসেছিল এই বাণিজ্যের হাত ধরেই। কারণ কথায় বলে বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী! এই আলোচনায় কথা হবে বাঙালির প্রাচীন কালের ব্যাবসার সেই ঐতিহ্য নিয়ে!


আজ থেকে পাঁচশ বছর আগের বাঙালির ব্যাবসার কোনো গল্প কি আপনি জানেন? আমার মনে হয় জানেন। বেহুলা-লখিন্দরের গল্প আমরা সকলেই সংক্ষেপে বা বিশদে শুনেছি। সেখানে রয়েছে চাঁদ সদাগরের গল্প। সাগরে সপ্তডিঙা ভাসিয়ে চাঁদ যেতেন বাণিজ্য করতে। মনসার সঙ্গে সংঘাতের পর মনসার কোপে তাঁর বাণিজ্যের সম্বল, প্রতিপত্তি সবই হারান চাঁদ সওদাগর। কিন্তু তাতে চাঁদ বণিকের বণিকসত্তাকে নস্যাৎ করা যায় না। তেমনই শুনেছি চণ্ডীমঙ্গলের ধনপতি সওদাগরের গল্প। সপ্তডিঙা, ময়ূরপঙ্খী নাও নিয়ে তাদের বাণিজ্যে যাওয়ার নানা গল্প। এছাড়াও রূপকথায় রাজপুত্র-রাজকন্যার গল্পের সঙ্গে বণিক পুত্রের গল্পও আমরা শুনেছি। এখন প্রশ্ন হলো যদি বাণিজ্য আমাদের অতীতে না-ই থাকবে, তবে বাংলার ঘরে ঘরে এই গল্পগুলো শয়ে শয়ে বছর ধরে বেঁচে থাকলো কীভাবে? সেই গল্পই কিন্তু বেঁচে থাকে, যে গল্প বলে বা শুনে মানুষ গর্ব অনুভব করে, আনন্দ পায়। যখন বাঙালির সব আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছিল, তখন সে নতুন প্রজন্মকে পুরোনো কালের গল্প বলতো, বলতো কেমন করে একদিন চাঁদ সদাগররা নৌকো নিয়ে পাড়ি দিত সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে! তারপরেও কয়েকশ বছর কেটে গেল। দেখুন, তবু আজও গল্পগুলো কিছু কিছু রয়ে গেছে, নেহাত গল্প বা গল্পের অবশেষ হয়েই! আজ সেই গল্পের দিনকালেই আমাদের অভিযান!


আমাদের মঙ্গলকাব্যে বাঙালি বণিকদের কথা আছে। এবং লক্ষ করলে দেখবেন, তারাই কিন্তু সেখানে সমাজের উপরিতলায়। এই কারণেই মনসা বলুন বা চণ্ডী এই দেবীরা পুজো চেয়েছেন বণিকের হাতে, রাজার হাতে নয়। কারণ চাঁদের মতো তখনকার বণিকশ্রেষ্ঠরা যদি সমাজের নিচুতলার মানুষের দেবদেবীদের স্বীকার করে নেন, তবেই নিম্নেতর গোষ্ঠীর আরাধ্যরা মান্যতা পাবেন, সমাজের সব অংশ তাঁদের গ্রহণ করবে। তবে মঙ্গলকাব্যে বাঙালির বাণিজ্যের যে গল্প আছে, সেটা খানিকটা অতিরঞ্জিত। কারণ তখন তা স্মৃতিবাহিত। অর্থাৎ তখনকার দিনে দাঁড়িয়ে, তারও পুরনোকালের। কারণ বাঙালির বাণিজ্যের গৌরবোজ্জ্বল সময়টা মধ্যযুগ নয়, প্রাচীনযুগের। মানে আজ থেকে হাজার বছরেরও বেশি সময় আগের। আর মঙ্গলকাব্য লেখা হয়েছে পঞ্চদশ শতকের পর থেকে, মানে আজ থেকে পাঁচশ বছর আগে। প্রমাণ হিসেবে বলা যায়, এরও সাতশ বছর আগে, অষ্টম শতকের একটা লিপি পাওয়া গেছে হাজারিবাগ জেলার দুধপানি পাহাড়ে। সেখানে বলা হয়েছে কোনো এক সময়ে তিন ভাই অযোধ্যা থেকে তাম্রলিপ্তিতে এসে প্রচুর ধনরত্ন উপার্জন করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেকালের বাঙালির বাণিজ্যে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এই তাম্রলিপ্তি বন্দরের।


এই পর্বে আমাদের আলোচনা মূলত বাঙালির বহির্বাণিজ্য নিয়ে। অর্থাৎ বাংলার সঙ্গে বহির্বঙ্গ ও অন্যান্য দেশের বাণিজ্য ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের বিষয়ে। আর এই বহির্বাণিজ্য স্থলপথে হলেও, অধিকাংশ যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল জলপথে। বাঙালির যুদ্ধের যে খুব খুব সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে -এমন আমরা খুব একটা শুনিনি। কিন্তু নৌশক্তিতে বঙ্গোপসাগরে তখন বাঙালিরই প্রভাব ছিল সবথেকে বেশি। প্রাচীন বাংলার অনেক লিপিতে, সংস্কৃত সাহিত্যে তার প্রচুর উল্লেখ আছে। ষষ্ঠ শতকে, মানে আজ থেকে ১৪০০ বছরেরও বেশি সময় আগে মৌখরীরাজ ঈশানবর্মের হাড়হা লিপিতে গৌড়দেশবাসীদের ‘সমুদ্রাশ্রয়ান’ বলা হয়েছে। অর্থাৎ যারা সমুদ্রকে আশ্রয় করে রয়েছে। কালিদাস রঘুবংশে রঘুর দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে বাঙালিকে ‘নৌসাধনোদ্যতান’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর (৫০৭-৮ খ্রিস্টাব্দ) লিপিতে, ধর্মাদিত্যের (সপ্তম শতক) তাম্রপট্টোলীতে পোতাশ্রয় ও জাহাজ নির্মাণ-মেরামতির বন্দরের কথা আছে। মোদ্দা কথা হলো জলপথে বাণিজ্য করার জন্য যে নৌবহরের দরকার, নৌশক্তির দরকার, তা প্রাচীনকালে বাঙালির ছিল। এবং সেই সময়ে বাংলার বাণিজ্য নির্ভর করতো দুটি বন্দরের উপর, তাম্রলিপ্তি ও গঙ্গা বন্দর।


আজ আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা রাস্তাঘাট অনেক উন্নত। সেই সময়ও মানুষ কিন্তু নিজের রাস্তা নিজেই তৈরি করেছিল। বলা যেতে আজ আমরা অনেকক্ষেত্রেই সেইসব প্রাচীন পথ অনুসরণ করি। সপ্তম শতকে য়ুয়ান চোয়াং (হিউয়েন সাঙ) বারাণসী, বৈশালী, পাটলিপুত্র, বুদ্ধগয়া, রাজগৃহ, নালন্দা, অঙ্গ-চম্পা হয়ে উত্তর রাঢ়বঙ্গে এসেছিলেন। সেখান থেকে গিয়েছিলেন পুণ্ড্রবর্ধনে। পুণ্ড্রবর্ধন থেকে আবার একটা নদী পার হয়ে তিনি যান কামরূপ, সেখান থেকে সমতট অর্থাৎ ত্রিপুরা, ঢাকা, খুলনা হয়ে বরিশাল অঞ্চলে। তারপর তাম্রলিপ্তি, তাম্রলিপ্তি থেকে কর্ণসুবর্ণ অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ হয়ে ওড্র অর্থাৎ উড়িষ্যা ও কলিঙ্গে। অর্থাৎ মোটামুটি ভাবা যেতে পারে এই পথগুলি ধরেই অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্য চলতো। বিদ্যাপতির ‘পুরুষপরীক্ষায়’ গৌড় থেকে গুজরাট পর্যন্ত বাণিজ্যপথের কথা আছে। এছাড়া কামরূপ হয়ে আফগানিস্তান, তিব্বত; চট্টগ্রাম থেকে আরাকান; তাম্রলিপ্ত থেকে মুর্শিদাবাদ হয়ে উড়িষ্যা, অন্ধ্র, মহারাষ্ট্রে বিস্তৃত ছিল বাণিজ্যের স্থলপথ। তবে ওই যে বললাম স্থলপথের চেয়ে জলপথের প্রাধান্যই ছিল বেশি। কারণ সারাবাংলা জুড়ে নদনদীর তো অভাব নেই। রয়েছে সমুদ্রউপকূলও। বাংলা থেকে সিংহল, সেখান থেকে মলয়, নিম্ন-ব্রহ্ম, সুবর্ণদ্বীপ, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, চম্পা, কম্বোজে বাঙালি বণিকদের যাতায়াত ছিল। আবার আরব, পারস্য প্রভৃতি দেশ এবং রোম, গ্রিসের সঙ্গেও বাঙালির বাণিজ্যিক যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল। তবে সেটা আরব সাগরের মাধ্যমে। পশ্চিমভারতের গুজরাটের সোপারা বন্দরের মাধ্যমে মূলত এই বাণিজ্য হতো। শুনলে অবাক হবেন এই সোপারা থেকেই রপ্তানি হতো বলে সুপারির নাম সুপারি হয়েছে। আগে তার নাম ছিল গুবাক। আর এই গুবাক বা গুয়া ক্রয়-বিক্রয়ের একটা বড়ো হাট ছিল আসামে। সেই হাটের নামটা আজ আন্দাজ করতে পারছেন? গুবাকের হাট, গুয়াহাটি!


গুবাকের প্রসঙ্গে বলি, বাংলায় তখন অন্যতম অর্থকরী ফসল ছিল এই গুবাক বা সুপারি। আর তারা রপ্তানি করতে সঙ্গে করে নিয়ে যেতেন পান ও নারকেল। এই দ্রব্যগুলিকে নিছক মামুলি জিনিস ভাবলে ভুল হবে। এই গুবাকের বিনিময়েই বাংলায় আসতো মাণিক্য। পানের বদলে আসতো মকরত মানে পান্না। আর নারকেলের বদলে শঙ্খ। বাংলা থেকে তেজপাতা ও পিপ্পলও রপ্তানি করা হতো। সেখান থেকে আসতো বিপুল পরিমাণ অর্থ। তার পরিমাণ সম্পর্কে খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে, মানে প্রায় ২০০০ বছর আগে লেখা প্লিনির ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে তার একটা ধারণা দেওয়া আছে। তখন রোমে আধ সের বা এক পাউন্ড পিপ্পলির দাম ছিল, তখনকার দিনে পনেরোটি স্বর্ণমুদ্রা। প্লিনি বলছেন তখন শুধু রোমেই বছরে এক লক্ষ স্বর্ণমুদ্রার রেশম ও কার্পাসবস্ত্র রপ্তানি করা হতো। আর এই তাঁত শিল্পে বাংলার কথা বলাই বাহুল্য। এই বস্ত্রসম্পদের একটা বড়ো অংশ যেত বাংলা থেকে।


এই বাণিজ্যের উপর ভর করেই পুণ্ড্রবর্ধনের উত্থান, গঙ্গাহৃদির বিকাশ এবং বাংলার বিভিন্ন প্রাচীন জনপদের সমৃদ্ধি। এসব আমাদের স্বর্ণময়, সোনার অতীত, এবং না-শোনা অতীত। খুঁজতে খুঁজতে পড়তে পড়তে যেটুকু পেয়েছি, তারই কিছুটা এই পরিসরে আপনাদের সঙ্গে গল্প করলাম। আশাকরি এই সব গল্প আপনারাও অন্যদের সঙ্গে ভাগ করে নেবেন, এই লেখাটি অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করার মাধ্যমে। আর আপনি যদি এই প্রসঙ্গে আরও কিছু তথ্য ও গল্প সংযোজন করতে চান তাহলে আমাদের নির্দিষ্ট ঠিকানায় পাঠিয়ে দিন আপনার লেখাটি।


তথ্যসূত্র:

  1. বাঙালির ইতিহাস: নীহাররঞ্জন রায়

  2. The Archaeology of Coastal Bengal: Rupendra Kumar Chattopadhyay

  3. Rivers of the Ganga-Brahmaputra-Meghna Delta: A Fluvial Account of Bengal: Kalyan Rudra

  4. “Tamralipti: The Ancient port of India”: ‘Studies in History and Culture’ – S. Tripathi & S.R. Rao

  5. https://www.peepultree.world/livehistoryindia/story/lost-cities/tamralipti-the-ancient-copper-port

  6. Partners in Empire: Dwarkanath Tagore and the Age of Enterprise in Eastern India: Blair B. Kling

 

 

The History of Bengali Trade in Ancient Times

Comments

Rated 0 out of 5 stars.
No ratings yet

Add a rating
bottom of page