ভারতের নামী-দামি ব্যবসায়ীদের কথা উঠলেই আমাদের মনে পড়ে টাটা, আম্বানি, আদানিদের নাম। কিন্তু এমন কতজন আছেন, যাঁরা কোনো বাঙালির নাম এই তালিকায় তুলে ধরতে পারবেন? আমাদের দেশবাসী হয়তো এখনকার বড়ো ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে জানে, কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, বাঙালির প্রথম বিজনেস টাইকুন কে ছিলেন, অধিকাংশ মানুষই হোঁচট খাবে। তবে, এই প্রশ্নের উত্তর জানা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ প্রায় দুই শতাব্দী আগে, যখন ভারত ছিল ব্রিটিশদের শাসনের অধীনে, তখন এক বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন ভারতের প্রথম বিজনেস টাইকুন, যার প্রভাব ও বৈভব সেই সময়ের অনেক বিখ্যাত ব্যবসায়ীকে ছাপিয়ে গিয়েছিল।
দ্বারকানাথ ঠাকুর: বাঙালির প্রথম শিল্পপতি
দুশো বছর আগে, যখন ভারত ছিল ব্রিটিশদের করায়ত্ত, তখন এক বাঙালি তৈরি করেছিলেন এক অসাধারণ ধন-সম্পদ এবং সামাজিক মর্যাদা, যা ব্রিটিশরাও উপেক্ষা করতে পারেনি। এই সময়কালে ব্রিটিশ ক্লাবগুলোতে ভারতীয়দের প্রবেশ নিষেধ ছিল, যা তখনকার সমাজে ভারতীয়দের অবস্থানকে স্পষ্ট করে তুলেছিল। তবু, এই কঠোর সমাজব্যবস্থার মধ্যেও এক বাঙালি হয়ে উঠেছিলেন একজন ধনী শিল্পপতি এবং ব্রিটিশ রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যিনি এমন উচ্চমহলের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন যা তখনকার ভারতের ভাইসরয়ও পাননি।
জমিদারি থেকে শিল্পপতির উত্থান
১৭৯৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। তাঁর উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি এবং সম্পদ তাঁর জীবনের ভিত্তি তৈরি করেছিল, কিন্তু তিনি এ নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর সমসাময়িক জমিদারদের মতোই তিনি সহজেই বিলাসিতায় জীবন কাটাতে পারতেন, কিন্তু তিনি জমিদারিকে শুধু একটি আয়-রোজগারের মাধ্যম হিসেবে না দেখে, একে ব্যবসায়িক সম্ভাবনা হিসেবে দেখেছিলেন। জমিদারি থেকে উপার্জিত আয়কে তিনি বিভিন্ন শিল্প ও বাণিজ্যিক উদ্যোগে বিনিয়োগ করেছিলেন।
তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে জমিদারি চালাতে হলে, তৎকালীন জটিল রাজস্ব আইন সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি। তাই তিনি ব্যারিস্টার রবার্ট কাটলার ফার্গুসনের কাছ থেকে শিখেছিলেন আইনের খুঁটিনাটি, এবং এই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি আইন ব্যবসায়েও সফল হয়েছিলেন। জমি-বিবাদ সংক্রান্ত মামলায় তিনি ছিলেন বিশেষজ্ঞ, এবং এই কাজ থেকে তাঁর মাসিক আয় ছিল প্রায় ১৫,০০০ টাকা—যা তখনকার সময়ে একটি বিশাল পরিমাণ অর্থ।
বহুমুখী উদ্যোগের বিস্তার
জমিদারি এবং আইন ব্যবসার বাইরেও দ্বারকানাথের চোখ ছিল অন্যান্য ব্যবসায়িক সুযোগের দিকে। তিনি সমুদ্রবাণিজ্যের সম্ভাবনা অনুধাবন করেছিলেন এবং ১৮২১ সালে জন ল্যানড্রিন স্যান্ডার্সের সঙ্গে যৌথভাবে ‘রেজ়লিউশন’ নামের একটি জাহাজে করে বুয়েনস এয়ার্সে রপ্তানি করেছিলেন মৌরি, জায়ফল এবং আখের রস থেকে তৈরি রাম। এই বাণিজ্য উদ্যোগটি অত্যন্ত সফল হয়েছিল।
তিনি শুধু সমুদ্রবাণিজ্যে থেমে থাকেননি। ১৮২৯ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ভারতের প্রথম স্বাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক ‘ইউনিয়ন ব্যাংক’। এর আগে ১৮২২ সালে তিনি ‘ওরিয়েন্টাল লাইফ অ্যাস্যুরেন্স সোসাইটি’ নামের একটি বিমা সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন। ভাবা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে একজন বাঙালি ব্যাংক ও বিমা ব্যবসায় প্রবেশ করেছিলেন!
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
দ্বারকানাথ শুধু ব্যবসায়িক উদ্যোগেই থেমে থাকেননি, তিনি ছিলেন তৎকালীন কলকাতার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ব্রিটিশদের প্রভাবশালী সমাজে তাঁর প্রবেশ ছিল উল্লেখযোগ্য, এবং তিনি কলকাতার ইংরেজি সংবাদপত্র, থিয়েটার হল, এমনকি যৌনপল্লীগুলোর ব্যবসায়ও জড়িত ছিলেন। ১৮৩৪ সালে তিনি ‘কার, টেগোর অ্যান্ড কোম্পানি’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা এদেশে প্রথম ব্রিটিশদের সঙ্গে বাঙালির যৌথ উদ্যোগে গড়ে ওঠা সংস্থা। এই সংস্থাটি নীলচাষে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং ধীরে ধীরে নীল-ব্যবসায় এক অন্যতম শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
ব্যবসার প্রসার ও উত্তরাধিকার
দ্বারকানাথ ঠাকুরের উদ্যোগগুলি ছিল বহুমুখী এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন একজন পথপ্রদর্শক। তাঁর খনির ব্যবসা, জাহাজ টানার ব্যবসা এবং স্টিম নেভিগেশনের উদ্যোগ তাঁকে ভারতের প্রথম বিজনেস টাইকুন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। তাঁর মৃত্যুর পরেও তাঁর উদ্যোগগুলির প্রভাব ছিল ব্যাপক। যদিও তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পরিবার কিছুটা অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়েছিল, তবু তাঁর ব্যবসায়িক উদ্যোগগুলি এবং সমাজে তাঁর প্রভাব আজও প্রাসঙ্গিক।
দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনের গল্প আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণা হতে পারে। তাঁর জীবন আমাদের দেখায়, কীভাবে একজন বাঙালি ব্যবসায়ী তাঁর যুগের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এক আন্তর্জাতিক মানের শিল্পপতি হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাঁর অবদান এবং উত্তরাধিকার আমাদের কাছে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, এবং তা আমাদের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে রয়ে যাবে।
তথ্যসূত্র:
‘দ্বারকানাথ ঠাকুর: বিস্মৃত পথিকৃৎ’: কৃষ্ণ কৃপালনী, অনুবাদ ক্ষিতীশ রায়
‘দ্বারকানাথ ঠাকুরের জীবনী’: ক্ষিতীন্দ্রনাথ ঠাকুর
‘মেমোয়ার অব দ্বারকানাথ টেগোর’: কিশোরীচাঁদ মিত্র
‘পার্টনার ইন এম্পায়ার: দ্বারকানাথ টেগোর অ্যান্ড দ্য এজ অফ এন্টারপ্রাইজ ইন ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’: ব্লেয়ার বি. ক্লিং
Comentarios