top of page
Pink Paper
  • Writer's pictureAnirban Das

বিধানচন্দ্র রায়: ধন্বন্তরি ডাক্তারের গল্প

Updated: Sep 7

বিধানচন্দ্র রায়কে আপনি কীভাবে চেনেন? ধন্বন্তরি ডাক্তার? -যাঁর ডাক্তারি নিয়ে ছড়িয়ে আছে একের-পর-এক মিথ। যাঁর রোগীদের তালিকায় রয়েছেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু থেকে রবীন্দ্রনাথ? নাকি আপনার কাছে তিনি প্রথমে বাংলার রূপকার, এবং বাংলার দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী? নাকি এক অমর প্রেমিক? প্রচলিত গল্প অনুযায়ী, যিনি তাঁর প্রেমকে অমর করে রেখেছেন নদিয়ার কল্যাণী শহরের নামের মধ্যে দিয়ে! ডাঃ বিধানচন্দ্রের বর্ণময় চরিত্রের নানা দিক রয়েছে। রয়েছে অনেক মিথ আর বিতর্ক। তবে এই পরিসরে আজ প্রথমে কথা হবে ডাক্তার বিধানচন্দ্রকে নিয়ে। কেন তাঁকে বলা হয় পশ্চিমবঙ্গের রূপকার -সেই বিষয়ে নয় কথা হবে পরে আরেকটি প্রতিবেদনে!


তিনি রাজা প্রতাপাদিত্যের বংশধর

১৮৮২ সালের ১ জুলাই বিহারের বাঁকিপুরে বিধানচন্দ্র রায়ের জন্ম। তাঁর পিতার নাম প্রকাশচন্দ্র রায় আর মা অঘোরকামিনী দেবী। তবে বিধানচন্দ্রের প্রথম নাম কিন্তু ‘বিধানচন্দ্র’ ছিল না। ঠাকুমা প্রথমে আদর করে তাঁর নাম রেখেছিলেন ভজন। পরে ব্রাহ্মসমাজের কেশবচন্দ্র সেন, বিধানচন্দ্রের নামটি ঠিক করে। বিধানচন্দ্রের বাবা প্রকাশচন্দ্র ছোটোবেলা থেকে নানা ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে গিয়ে সরকারি চাকরির উচ্চপদে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। প্রকাশচন্দ্র ও অঘোরকামিনী দুজনেই ছিলেন ধর্মপরায়ণ। জীবনযাপনে তাঁদের কোনো আড়ম্বর ছিল না। একটা সময়ে প্রকাশ্চন্দ্র খ্রিস্টধর্মের প্রতি অনুরক্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি ব্রাহ্মসমাজে যুক্ত হন। বিধানচন্দ্রের মা অঘোরকামিনী দেবীও ছিলেন সেই যুগের নিরিখে ব্যক্তিক্রমী। বিয়ের পরে সংসার ছাড়াও তাঁর আলাদা একটা কর্মজগৎ ছিল। স্বামীর উৎসাহে নিজে লেখাপড়া শিখেছিলেন, এবং তার পরে আজীবন তিনি কাজ করেছেন মহিলাদের শিক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। দীর্ঘজীবন তিনি পাননি। বিধানচন্দ্রের বয়স যখন ১৪ বছর, তখনই তিনি মাতৃহারা হন। কিন্তু তারমধ্যেই শিশু, অনাথ ও দরিদ্রদের সেবায় তিনি আত্মনিয়োগ করেছিলেন। মা-বাবাকে স্মরণ করেই বিধানচন্দ্র বলতেন তাঁদের কাছে আমি তিনটে জিনিস শিখেছি- স্বার্থহীন সেবা, সাম্যের ভাব এবং কখনও পরাজয় মেনে না নেওয়া। তবে বিধানচন্দ্রের দৃঢ় চরিত্রে তাঁর পূর্বপুরুষদেরও প্রভাব ছিল। কারণ তিনি ছিলেন রাজা প্রতাপাদিত্য রায়ের উত্তর পুরুষ। ঠিকই ধরেছেন, এই প্রতাপাদিত্যই যশোহরের স্বাধীনচেতা রাজা প্রতাপাদিত্য রায়, যিনি ছিলেন ‘বারো ভুঁইয়া’দের একজন। সেই বংশেই জন্ম হয়েছিল শ্রী রায়ের।


ছাত্রাবস্থায় মারপিঠ-হাতাহাতিতে জড়ালেন বিধানচন্দ্র!

বিধানচন্দ্রের শিক্ষাজীবন শুরু পাটনাতেই। পটনা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৮৯৭ সালে এন্ট্রান্স পাশ করে ১৮৯৯-তে তিনি পটনা কলেজ থেকেই এফএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর পড়াশুরু করেন অঙ্কে অনার্স নিয়ে। তখন সায়েন্সেও দেওয়া হতো বিএ ডিগ্রি। ১৯০১-সালে সেই ডিগ্রি লাভ করে বিধানচন্দ্র আসেন কলকাতায়। কিছু একটা হতে হবে এই লক্ষ্য নিয়ে। কারণ তাঁর বড়দা ছিলেন ব্যারিস্টার। আর মেজদা ইঞ্জিনিয়র। তাই তিনিও স্বপ্ন দেখতেন ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়র হবেন। সেইমতো কলকাতায় এসে তিনি ভর্তির আবেদন করেন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ ও শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। ডাক্তারিতে ভর্তির তালিকাটিই এরমধ্যে আগে প্রকাশিত হয়। এবং বিধান রায় মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়া শুরু করেন।


শুরুতে কলকাতা শহরের চাকচিক্য, বৈভবের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারতেন না নিজেকে। থাকতেন প্রেসেডেন্সি কলেজের কাছে ওয়াইএমসিএ হস্টেলে। যখন বিধানচন্দ্র দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন তাঁর বাবা অবসর নেন। ফলে নিজের খরচ জোগাড় করতে কখনও বেসরকারি নার্সিং হোমে পুরুষ নার্স, কখনও বড় ডাক্তারের সহায়ক-ছাত্র হিসেবে কাজ করতেন তিনি। এই সময়েই ঘটে যায় একটি ঘটনা। ১৯০১-এর পরের সময়টা বাংলার রাজনীতিতে উত্তাল। কারণ এরপর ১৯০৫-এ চূড়ান্ত আকার ধারণ করবে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন। সেই ১৯০৫ সালেই একবার কলকাতা থেকে বিধানচন্দ্র ও তাঁর একবন্ধু মিলে ট্রেনে যাচ্ছিলেন বর্ধমান। কিন্তু সমস্যা হলো এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান দম্পতির সঙ্গে। যাঁরা কিছুতেই তাঁদের উচ্চশ্রেণির কামরায় উঠতে দেবেন না। শেষ পর্যন্ত ভদ্রলোকের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন বিধানচন্দ্র। এবং ওই কামরাতেই তাঁরা বর্ধমান রওনা হন। ঘটনাটি সম্পর্কে পরে তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘মনে হয়েছিল, আমরা যেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করে ফেলেছি!’’


মিথ্যা সাক্ষ্য না দেওয়ায় ফেল করলেন ডাক্তারিতে!

বিধানচন্দ্র রায় হয়ে উঠেছিলেন ধন্বন্তরী ডাক্তার। তাঁর ডাক্তারি নিয়ে এখনও শোনা যায় নানা মিথ। কিন্তু সেই জায়গাটায় পৌঁছনো তাঁর পক্ষে সহজ ছিল না। আগেই বলেছি, বাবা অবসর নেওয়ার পর অর্থনৈতিক দিক থেকে একটা সমস্যা ছিলই, তবে বিধানচন্দ্রের জন্য আরও বড়ো সমস্যা অপেক্ষা করছিল। মেডিক্যাল কলেজে বিধানের ‘আদর্শ’ ছিলেন তাঁর অধ্যাপক কর্নেল লিউকিস। তাঁর কাছেই ডাক্তারির পাশাপাশি জাতীয়তাবোধের শিক্ষাও পেয়েছিলেন বিধানচন্দ্র। কর্নেল তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘কোনও সাহেবের সামনে একবার একটু মাথা নোয়ালে তিনি তোমাকে দ্বিগুণ নত করতে চাইবেন!’’ বিধান সেটা বুঝে চলতেন। আর এর জন্যই অনেক বড়ো মূল্য দিতে হয়েছিল বিধানচন্দ্রকে।

মেডিক্যাল কলেজে একজন অধ্যাপক ছিলেন পিক সাহেব। একদিন কলেজের সামনে একটি পথ দুর্ঘটনা ঘটে গেল। মেডিক্যাল কলেজের গেটের সামনে অধ্যাপক পিক-এর ঘোড়ার গাড়িকে ধাক্কা মারলো একটি ট্রাম। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বিধান রায়। পরে অধ্যাপক পিক তাঁকে এই মামলায় এই মর্মে সাক্ষী দিতে বলেন যে, দোষ ট্রামের, ঘোড়ার গাড়ির কোনো দোষ নেই। কিন্তু বিধান রায় বলেন যে, প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে তিনি দেখেছেন দোষ আসলে ঘোড়ার গাড়ির। তাই তাঁকে সাক্ষ্য দিতে হলে তিনি সেটাই বলবেন। স্বাভাবিকভাবেই রুষ্ট হন অধ্যাপক পিক। জের গড়ায় এবং ‘এমবি’ পরীক্ষার মৌখিক অব্দি। যেখানে পিক তাঁকে ‘পাস মার্কস’দেননি। অগত্যা অধ্যাপক লিউকিসের পরামর্শে তিনি এলএমএস পরীক্ষায় বসেন। এবং সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মেডিক্যাল কলেজে কর্নেল লিউকিসের অধীনেই শল্য চিকিৎসক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তখন তিনি প্রাইভেটে রোগী দেখতেন দু’ টাকা ভিজিটে।


নেটিভ ডাক্তারের আরও যুদ্ধ তখনও বাকি!

তবে যুদ্ধ আরও বাকি ছিল। ডাক্তারির সঙ্গে সঙ্গে বিধানচন্দ্র চালিয়ে যেতে থাকেন এমডি-র জন্য থিসিস লেখা। তাঁর পরিকল্পনা ছিল দু’ বছরে এমডি হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে যাওয়া। সেই মতো দু’ বছর পরে যখন তিনি বিলেতে পড়তে যাওয়ার জন্য বেতনহীন ছুটি চান, তখন তাঁকে বলা হয়, ভারতীয়ের এটা প্রাপ্য নয়। অথচ এই একই ডিগ্রি নিয়ে ইউরোপিয়ান ডাক্তারেরা সবেতন ছুটি পান। তাই বিধান রায় এই বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে, আর্জি জানান লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে। সেখানে তাঁর যুক্তি ও সবেতন ছুটি মঞ্জুর হয়।


তবে এবার নতুন সমস্যা আসে জাহাজে। জাহাজে দুই শয্যার কেবিন। সেখানে বিধান রায়ের সহযাত্রী একজন সাহেব। তাই ‘নেটিভ বেঙ্গলি’কে সাহেবের সঙ্গে একত্রে যেতে দিতে নারাজ জাহাজ সংস্থা। অবশেষে যুক্তি-যুদ্ধে তারও মীমাংসা হয়। এবং ১৯০৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি লন্ডন রওনা হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমডি ডিগ্রিধারী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়।


বিধানচন্দ্র ভর্তি হতেন সেখানকার সেন্ট বার্থোলোমিউস কলেজে। যেখানে ভর্তির ব্যাপারে কলেজের প্রাক্তনী এবং কলকাতা মেডিক্যালের অধ্যক্ষ কর্নেল লিউকিস তাঁকে একটি সুপারিশপত্রও লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু কলেজের ডিন ডাঃ শোর পত্রপাঠ জানিয়ে দেন যে এখানে হবে না। বিধানও নাছোড়বান্দা। তিনি জানেন, একই সঙ্গে এমআরসিপি এবং এফআরসিএস করার এটিই সবচেয়ে ভাল প্রতিষ্ঠান। শেষ পর্যন্ত বিধানের ‘চাপে’ কার্যত অতিষ্ঠ হয়েই কিছু দিন পরে ডিন বিধানচন্দ্রকে ভর্তি করে নেন। অ্যানাটমি, চর্মরোগ, ফিজিওলজি, হাড়ের চিকিৎসা ইত্যাদিতে বিধানের আগ্রহ সেখানকার চিকিৎসকদের নজর কাড়ে। এদেশের তুলনায় বিলেতে ওই সব বিষয়ের চিকিৎসা পদ্ধতি অনেক উন্নতমানের ছিল তখন। বিধানচন্দ্র অল্প দিনে সেগুলি আয়ত্ত করেন।


এরপর মাত্র দু’ বছরের মধ্যে ১৯১১-র মে মাসে বিধানচন্দ্র একই সঙ্গে এফআরসিএস (শল্য চিকিৎসা) এবং এমআরসিপি (মেডিসিন) হওয়ার সম্মান অর্জন করেছিলেন। তখন সেই ডিন ডাঃ শোরই তাঁকে বলেছিলেন, ‘‘ডাঃ রায়, আমি প্রথমে তোমাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ আমার আগের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছিল, বাঙালিরা এখানে পড়ার যোগ্য নয়। আজ বলছি, এখন থেকে তোমার সুপারিশ নিয়ে যে পড়তে আসবে, তার জন্য এই কলেজের দরজা খোলা থাকবে।” তারপর বহুদিন সেই ব্যবস্থা সেখানে চালু ছিল।


এরপর ১৯১১-র জুলাইতে বিধানচন্দ্র রায় কলকাতায় ফেরেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অধ্যাপক হিসেবে যুক্ত হবেন। কিন্তু তাঁকে জানিয়ে দেওয়া হয়, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপকের পদ শুধু ইংরেজদের জন্য। তাই ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিস অফিসার তাঁর হওয়া হবে না। বিধানচন্দ্র চাইলে জেলায় মেডিক্যাল অফিসার হতে পারেন, নয়তো ক্যাম্বেল (এখনকার এনআরএস) মেডিক্যাল স্কুলের শিক্ষক। তবে ক্যাম্বেলে তিনি সুযোগ পেয়েছিলেন এক বছর পরে। তত দিন বিলেত ফেরত এফআরসিএস-এমআরসিপি এই ডাক্তার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে শুধু পুলিশদের ফার্স্ট-এড এবং অ্যাম্বুল্যান্স ডিউটি শিখিয়েছেন।


ধন্বন্তরি ডাক্তার

এরমধ্যেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের নাম। ক্রমে তিনি হয়ে উঠছেন রোগীর ভগবান, ধন্বন্তরী! এরকম নানা গল্প আছে, তাঁকে নিয়ে। তেমনই একটা গল্প বলি। একবার হয়েছে কী, এক রোগীর কানে অসহ্য যন্ত্রণা। গ্রামের মানুষ, তাই পুকুরে স্নান করা তার নিত্য ব্যাপার। সবাই বললো, ও কিছু নয়, কানে জল ঢুকেছে। তাই ব্যথা। এটা ওটা সেটা করে অনেক চেষ্টা চললো, কিন্তু ব্যথা কিছুতেই কমে নয়, ক্রমে অসহ্য হয়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে রোগীকে নিয়ে তার পরিবার চললো কলকাতায়। কারণ এর উপশম একমাত্র করতে পারেন  ভগবান ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়। তখন বিধানচন্দ্র মুখ্যমন্ত্রী। দিনে ১৬ জনের বেশি রুগী দেখেন না। শত চেষ্টা করেও কানে যন্ত্রণার রুগী সময়ে পৌঁছাতে পারলেন না। তবে ব্যথায় কাহিল রুগীকে দেখে মায়া হলো কমপাউন্ডারের। তিনি অনেক অনুনয় করে রাজি করালেন ভগবান ডাক্তারকে। ডাক্তার বিধানচন্দ্র কিছুক্ষণ দেখেই রোগীকে ঘুমের ইনজেকশন দিলেন। তারপর রুগীর দুই কানের পাশে পাকা কাঁঠালের কয়েকটি কোয়া রাখলেন। সবাই আশ্চর্য হয়ে গেলেন। এ আবার কেমন ডাক্তারি! একটু পর দেখা গেল রোগীর দুই কান থেকে পিলপিল করে কাঁঠালের গন্ধে বেরিয়ে আসছে পিঁপড়ে। ভগবান বললেন, পানা পুকুরে চান করে নিশ্চই। ঐখান থেকেই পিঁপড়ে ঢুকেছে কানে।


তাঁর এরকম প্রবাদপ্রতিম চিকিৎসা-কাহিনিগুলি আজও মুখে মুখে ফেরে। প্রাক্তন আমলা নীতীশ সেনগুপ্ত এমনই এক ঘটনার কথা বলছেন, যে একদিন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্রকে ফাইল দেখাতে এসেছেন এক অফিসার। মুখ নিচু করে তিনি দেখছেন এবং শুনছেন। হঠাৎ চোখ তুলেই অফিসারকে দেখে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘কী করছ এখানে? এখুনি সোজা পিজি হাসপাতালে চলে যাও। আমি বলে দিচ্ছি।” অফিসার তো হতভম্ব। পিজি-তে গেলেন। পরে বিধান রায় বলেছিলেন, ‘‘ওঁর ঠোঁটে একটা খারাপ ইনফেকশনের উপসর্গ দেখেছিলাম। দেরি করলে বিপদ হতে পারত।”


ডাক্তারির ফি ৩০০ কোটি টাকা!!

একবার বিধানচন্দ্র ডাক্তারি করে রোগীর থেকে কত ফি নিয়েছিলেন জানেন? ৩০০ কোটি টাকা! হয়েছিল কী, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কেনেডির সঙ্গে একবার দেখা হয় বিধানচন্দ্রের। তখন আচমকাই বিধান রায় তাঁকে প্রশ্ন করেন, “আপনার পিঠে কি ব্যথা করে?” শুনে হতবাক হয়ে যান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। জানান, সত্যিই বেশ কিছুদিন ধরে তিনি পিঠের ব্যথায় ভুগছেন। এরপর তাঁকে প্রেসক্রিপশন লিখে দেন বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে এও জানান, যে যদি ১ বছরের মধ্যে কেনেডি ভাল না হন, তাহলে নিজের অর্থ খরচ করে তিনি আমেরিকায় ফের আসবেন প্রেসিডেন্টকে দেখতে। তারপরেই মুচকি হেসে বিধানচন্দ্র রায় নিজের ফি-ও চান কেনেডির কাছে। সঙ্গে সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রশ্ন করেন, “বলুন, কত ফি চান আপনি?” তখন তাঁকে চমকে দিয়ে বিধানচন্দ্র বলেছিলেন, ৩০০ কোটি টাকা! যে অঙ্কের মার্কিন বিনিয়োগ তিনি এনেছিলেন বঙ্গদেশের জন্য।


বিধানচন্দ্র রায়ের বিখ্যাত রোগীরা

কেনেডি ছাড়াও ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী ক্লেমেন্ট অ্যাটলির হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করে সারিয়েছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। তাঁর ভিআইপি রোগীদের তালিকায় ছিলেন মহাত্মা গান্ধী থেকে রাজেন্দ্রপ্রসাদ, মতিলাল নেহরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ। একবার ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর খুব শরীর খারাপ। দিল্লির ডাক্তাররা দেখেছেন। কিন্তু সুরাহা হয়নি। তখন উদ্বিগ্ন হয়ে ইন্দিরা গান্ধী ও লালবাহাদুর শাস্ত্রী ডেকে পাঠান ডাক্তার বিধানচন্দ্রকে। প্লেনের ব্যবস্থা করাই ছিল, তড়িঘড়ি বিধানচন্দ্র দিল্লি পৌঁছলেন। আগের রিপোর্ট কিছু না দেখেই তিনি জহরলাল নেহেরুকে দেখে স্টেথোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করার পর পেটে দু-তিনবার থাবড়া মেরে শুনলেন। তারপর কাপড় কাচার সাবান আর গরম জল আনতে বলে লালবাহাদুর শাস্ত্রী বাদে সকলকে বেরিয়ে যেতে বললেন। তারপর তাঁর হাত গেল জহরলাল নেহেরুর পাজামার দড়িতে! আপত্তি করতে গিয়ে বিধান রায়ের বকা খেলেন নেহেরু। তারপর তিনি নেহেরুকে এনেমা দিলেন। এই প্রক্রিয়ার পর শরীরে একটু স্বস্তিবোধ করলেন নেহেরু। যদিও পুরোপুরি সুস্থ হতে তাঁর অনেকটা সময় লেগেছিল। আর এই সময়টায় নিয়মিত বিমানে দিল্লি কলকাতা করতেন বিধানচন্দ্র।


ডাক্তার বিধান রায়ের এরকম গল্প অনেক আছে। তাঁর দীর্ঘ চিকিৎসক জীবনের সেসব গল্প বলতে গেলে আজ আর এই আলোচনা শেষ হবে না। তাই আপাতত ইতি টানি! এর পরের পর্বে আমরা কথা বলবো মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়কে নিয়ে। কেন তাঁকে বলা হয় তিনি পশ্চিমবঙ্গের রূপকার।   


বিধানচন্দ্র রায়

Коментарі

Оцінка: 0 з 5 зірок.
Ще немає оцінок

Додайте оцінку
bottom of page