top of page
Pink Paper

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিজ্ঞানচিন্তা

Writer's picture: Anirban DasAnirban Das

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আমরা মূলত সাহিত্যিক, কবি, নাট্যকার ও সংগীতজ্ঞ হিসেবে চিনি। কিন্তু তাঁর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল বিজ্ঞানমনস্কতা। রবীন্দ্রনাথ শুধুমাত্র কবিতা, গান বা উপন্যাসেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না, তিনি বিজ্ঞান নিয়েও গভীর চিন্তাভাবনা করতেন। তাঁর লেখা বিশ্বপরিচয় বইটি এ বিষয়ের এক উজ্জ্বল উদাহরণ। সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার সম্পর্কে তাঁর গভীর আগ্রহ ও জ্ঞানের পরিসর ছিল বিস্তৃত। তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসু ও আইনস্টাইনের মতো মহান বিজ্ঞানীদের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তাঁর এই বিজ্ঞানচেতনা এবং সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞান পৌঁছে দেওয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টাই আজকের এই লেখার মূল বিষয়।


ছোটোবেলা থেকে বিজ্ঞানচর্চার প্রতি আকর্ষণ

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচর্চার শুরু হয়েছিল ছোটোবেলা থেকেই। ঠাকুরবাড়ির শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান ছিল গুরুত্বপূর্ণ। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি গ্রহগণ জীবের আবাসভূমি নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন যা প্রকাশিত হয়েছিল বালক পত্রিকায়। তাঁর এই প্রবন্ধটি তিনি লিখেছিলেন বাবার সঙ্গে ডালহৌসিতে বেড়াতে গিয়ে গ্রহ-নক্ষত্র নিয়ে বাবার কাছ থেকে শোনা গল্পের প্রেরণায়। এই সময় থেকেই বিজ্ঞান নিয়ে তাঁর আগ্রহ জন্মায়, যা তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ধরে রেখেছিলেন।


ঠাকুরবাড়িতে সীতানাথ দত্তের মতো বিজ্ঞানচর্চাকারী ব্যক্তিদের নিয়মিত আসা-যাওয়া ছিল, যাঁরা হাতে-কলমে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখাতেন। এভাবেই রবীন্দ্রনাথ ছোটোবেলা থেকেই বিজ্ঞানের নানা বিষয় সম্পর্কে অবগত হতে শুরু করেন। এই সময় তিনি ‘বালক’ পত্রিকায় বিজ্ঞান নিয়ে ছোটদের জন্য লেখা শুরু করেন, যা তাঁর মধ্যে আজীবন বিজ্ঞানচর্চার ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল।


বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ কমেনি, বরং বেড়েছে। তিনি রবার্ট বল, সাইমন নিউকোম্বের মতো তৎকালীন বিখ্যাত বৈজ্ঞানিকদের বই নিয়মিত পড়তেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের সঙ্গে তাঁর গভীর বন্ধুত্ব ছিল। তিনি তাঁদের গবেষণা সম্পর্কে শুধু অবগতই ছিলেন না, তাঁদের গবেষণায় উৎসাহও দিতেন। এমনকি ত্রিপুরার রাজার সাহায্যে জগদীশচন্দ্র বসুর গবেষণার জন্য অর্থ সংগ্রহও করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। এভাবেই তিনি বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর আগ্রহ ও সম্মান প্রদর্শন করতেন।


তাছাড়া, পরিসংখ্যানবিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে তিনি উৎসাহিত করেছিলেন ভারতের প্রথম রাশিবিজ্ঞান শিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপনে, যা আজকের আইএসআই (ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট) হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত।


বিশ্বপরিচয়: সাধারণের বিজ্ঞানশিক্ষা

রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচেতনার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো তাঁর লেখা বই বিশ্বপরিচয়, যা ১৯৩৭ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটি তিনি লিখেছিলেন বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলি সহজ ভাষায় সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এই বইতে মহাবিশ্ব, পদার্থ, শক্তি ও প্রাকৃতিক ঘটনাবলি নিয়ে আলোচনা করেছেন তিনি, তবে এমন ভাষায়, যা সাধারণ মানুষের বোঝার উপযোগী।


ইউরোপ সফরের মাধ্যমে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি দেখে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন, ভারতের মানুষদের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষা কতটা জরুরি। তিনি বুঝেছিলেন যে, বিজ্ঞানশিক্ষা ছাড়া কোনো জাতির প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই তিনি চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ছড়িয়ে দিতে। বিশ্বপরিচয় বইটি ছিল তাঁর সেই প্রয়াসের অংশ। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “আমাদের মন অবৈজ্ঞানিক। এই দৈন্য কেবল বিদ্যার ক্ষেত্রে নয়, কাজের ক্ষেত্রেও আমাদের ব্যর্থ করে রাখছে।”

এই কথার মাধ্যমে তিনি স্পষ্টভাবেই বলতে চেয়েছিলেন যে, শুধুমাত্র বিদ্যার ক্ষেত্রেই নয়, দৈনন্দিন জীবনেও বিজ্ঞানচর্চার প্রয়োজন। বিশ্বপরিচয় ছিল তাঁর সেই প্রচেষ্টারই ফল, যেখানে তিনি সাধারণ মানুষের জন্য বিজ্ঞানের জটিল বিষয়গুলি সহজ করে বুঝিয়েছিলেন।


আইনস্টাইনের সঙ্গে আলাপ

আইনস্টাইনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আলাপচারিতা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা, যেখানে বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে এক অপূর্ব মেলবন্ধন ঘটেছিল। ১৯৩০ সালের জুলাই মাসে, জার্মানির বার্লিনে আইনস্টাইনের বাড়িতে তাঁদের এই আলোচনা হয়। আলোচনার মূল বিষয় ছিল বিশ্ব ও বাস্তবতার প্রকৃতি। রবীন্দ্রনাথ, একজন দার্শনিক হিসেবে, মনে করতেন যে, মানুষের চেতনার মাধ্যমেই জগৎকে বোঝা যায়; তাঁর মতে বাস্তবতা মানুষের উপলব্ধির ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে, আইনস্টাইন, যিনি পদার্থবিজ্ঞানী ছিলেন, বিশ্বাস করতেন যে বাস্তবতা মানুষের চেতনার বাইরে স্বতন্ত্রভাবেই বিদ্যমান।

যদিও তাঁদের দু’জনের মতের মধ্যে পার্থক্য ছিল, আলাপচারিতাটি ছিল অত্যন্ত আন্তরিক ও শ্রদ্ধাপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অস্তিত্ব মানুষের চেতনাশক্তির সঙ্গে জড়িত, যা দর্শনের একটি গভীর দিক। অন্যদিকে, আইনস্টাইন বলেছিলেন, "আমি বিশ্বাস করি প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে চলে, মানুষের চেতনাশক্তি ছাড়াই তার অস্তিত্ব থাকে।" যদিও আইনস্টাইন রবীন্দ্রনাথের দার্শনিক চিন্তাধারাকে সম্মান দেখিয়েছিলেন, তিনি এই বিষয়ে একমত হননি।


এই আলোচনা তাঁদের চিন্তার বিভিন্ন দিকগুলি তুলে ধরেছিল। তাঁদের মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, এই আলাপচারিতা ছিল একটি অসাধারণ উদাহরণ, যেখানে দু’জন মহৎ মনের মানুষ একে অপরের মতামতকে সম্মানের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। যদিও তাঁদের মধ্যে কোন নির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি, তবুও এটি বিজ্ঞান ও দর্শনের মধ্যে এক যুগান্তকারী আলোচনা হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে।

এই আলাপচারিতা থেকে বোঝা যায়, রবীন্দ্রনাথ এবং আইনস্টাইন দু’জনেই তাঁদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে কতটা বড় মাপের চিন্তাবিদ ছিলেন এবং তাঁদের চিন্তার গভীরতা মানব সমাজকে প্রভাবিত করেছে।


রবীন্দ্রনাথের বিজ্ঞানচর্চার উত্তরাধিকার

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজ্ঞানী ছিলেন না, কিন্তু তিনি নিঃসন্দেহে একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ ছিলেন। তাঁর লেখা, বিশেষ করে বিশ্বপরিচয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ছড়ানোর জন্য তাঁর যে প্রচেষ্টা ছিল, তা আজও আমাদের প্রেরণা দেয়। ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানচেতনা ঠিক কতটা জরুরি সেটা বুঝেই রবীন্দ্রনাথ লোকশিক্ষার জন্য তিনি সচেষ্ট হয়েছে। লিখেছেন ‘বিশ্বপরিচয়’। তিনি বলতেন “আমাদের মন আছে অবৈজ্ঞানিক হয়ে। এই দৈন্য কেবল বিদ্যার বিভাগে নয়, কাজের ক্ষেত্রে আমাদের অকৃতকার্য করে রাখছে”।


রবীন্দ্রসাহিত্য ঘেঁটে তাঁর এমন বিজ্ঞানসচেতনতা, বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা, ভারতের সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতা ছড়ানোর ঐকান্তিক ইচ্ছার অনেক নজির তুলে আনা যায়। কিন্তু সেটা আমাদের উদ্দেশ্য নয়, শুধু এটুকু বলতে চাই রবীন্দ্রনাথের করতে চাওয়া কাজ তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরও, আজ অসম্পূর্ণ। আজকেও আমাদের মধ্যে বিজ্ঞানসচেতনতার অভাব আছে। আমরা হয় জানি না, নইলে জানতে চাই না, না হলে কেবল মুখস্থ করি, নিজেদের জীবনে গ্রহণ করি না। তাই সায়েন্স আর আর্টস ঘটি-বাঙালের তর্কের মতো মুখোমুখি দাঁড়ায়। কিন্তু এরা একে ওপরের পরিপূরক। রবীন্দ্রনাথ সেটা বুঝেছিলেন, বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তাঁর ভাবনাকে আজ কতটা অনুধাবন করতে পেরেছি?


Rabindranath Tagore: The Scientist's Mind Behind the Poet

Recent Posts

See All

1 Kommentar

Mit 0 von 5 Sternen bewertet.
Noch keine Ratings

Rating hinzufügen
Gast
22. Sept. 2024
Mit 5 von 5 Sternen bewertet.

Gefällt mir
bottom of page